• বিশেষ প্রতিবেদন

ধামরাই‌য়ের ঐ‌তিহ্যবাহী রথযাত্রার শেষ মুহূ‌র্তের প্রস্তু‌তি সম্পন্ন

  • বিশেষ প্রতিবেদন
  • ০৬ জুলাই, ২০২৪ ২২:২০:০৭

ছবিঃ সিএনআই

মা‌নিকগঞ্জ প্রতিনিধিঃ প্রতিবছরের মতো এবারও ঢাকার ধামরাইয়ের রথযাত্রা ঘিরে সাজসজ্জা ও প্রস্তুতি শেষে সাজিয়ে তোলা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী রথ। দিন রাত সমান তালে সংস্কার ও সাজিয়ে তোলার কাজ করেছেন কর্মীরা।উৎসব যথাযথ ভাবে পালনে এরই মধ্যে প্রস্তুতি নিয়েছে প্রশাসন ও আয়োজকরা। শনিবার (৬ জুলাই) বি‌কে‌লে ধামরাই উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন রথখোলায় গিয়ে রথের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি নিতে আয়োজক ও শ্রমিকদের কর্মব্যস্ততা দেখা যায়।

শেষ মুহূর্তে চলছে রং তুলি ও সাজসজ্জার কাজ। আয়োজকদের দাবি, রথ শুরুর আগেই সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েছেন তারা।এ ছাড়া রথ টানতে এরই মধ্যে রশি ও চাকা পরীক্ষা করা হয়েছে। নেওয়া হয়েছে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। রথযাত্রা ঘিরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মাঝে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।  

আয়োজকরা জানায়, আগামী রবিবার (৭ জুলাই) ধামরাই বাজারের রথখোলা এলাকা থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত প্রথমে রথ টানা হবে। পরে ১৫ জুলাই উল্টোরথের মাধ্যমে পূজার আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে। রথ উৎসবকে কেন্দ্র করে ৭ জুলাই থেকে পরের এক মাস চলবে ঐতিহ্যবাহী মেলা। 

ধামরাই রথখোলা এলাকায় সঞ্জিত পাল নামে এক রংশিল্পী বলেন, গত ১১ বছর ধরে রথের সাজসজ্জার কাজ করে আসছি। এ বছরও গত কয়েকদিন ধরে এখানে রথ সাজানোর কাজ করছি। বৃষ্টি কারনে পলিথিন সাঁটিয়ে রংতুলির কাজ করতে একটু সমস্যা হচ্ছে তবে রথ টানের আগে কাজ শেষ হবে। চন্দন রায় নামে আরেক রংশিল্পী বলেন, রথের খুঁটি, দেবতাদের প্রতিকৃতিসহ সব রং করা হয়েছে।আজকের মধ্যে অন্যান্য কাজও সম্পন্ন হয়ে যাবে।

রথযাত্রার সর্বশেষ প্রস্তুতির বিষয়ে ধামরাই যশোমাধব মন্দির পরিচালনা পর্ষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নন্দ গোপাল সেন  বলেন, রথযাত্রা ও রথমেলা উপলক্ষে রথের সাজসজ্জা ও পরিচর্যার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। বৃষ্টি কারনে রংতুলির কাজ একটু দেরিতে হয়েছে তবে আজকের মধ্যে রংতুলির কাজ শেষ হয়ে যাবে। এরপর রথটান হবে।রথটানের দিন নিরাপত্তার স্বার্থে টি শার্ট পরিহিত প্রায় দুইশ জন স্বেচ্ছাসেবী থাকবে।  এছাড়া মাসব্যাপী মেলা হবে এর মধ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।

ধামরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম বড় উৎসব রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার সকল প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। পুলিশ প্রশাসেন সাথে কথা হয়েছে নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজনীয় সব জায়গায় পুলিশ মোতায়েন করা থাকবে। সেই সাথে রথমেলায় সাদা পোশাকে পুলিমসহ গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন  মোতায়েন থাকবে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলায় পাল বংশের রাজা যশোপাল একদিন হাতির পিঠে চড়ে ধামরাই অঞ্চলের পাশের গ্রাম শিমুলিয়া বেড়াতে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে হঠাৎ লাল মাটির একটি উঁচু ঢিবির সামনে রাজাকে বহনকারী হাতিটি থেমে যায়। শতচেষ্টা করেও মাহুত যখন হাতিকে সামনে নিতে পারলো না, তখন রাজা ভীষণ অবাক হলেন। রাজা যশোপাল তখন হাতি থেকে নেমে স্থানীয় লোকজন কে ওই মাটির ঢিবি খনন করার নির্দেশ দেন। রাজা নিজেই এই খনন কার্য তত্ত্বাবধান করেন। এক পর্যায়ে সেই মাটির ঢিবিতে একটি সুরক্ষিত মন্দিরের সন্ধান মিলে।

মন্দিরটিতে শ্রী বিঞ্চু মূর্তির অনুরূপ শ্রী মাধব মূর্তি পাওয়া যায়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাজা যশোপাল ছিলেন পূজাবৎসল ও খুবই ধার্মিক। তিনি ফিরে ধামরাই সদরে ঠাকুরবাড়ির পঞ্চাশ গ্রামের বিশিষ্ট পণ্ডিত শ্রী রামজীবন রায় কে ওই মাধব মূর্তি প্রতিস্থাপনের দ্বায়িত্ব দেন। শ্রী মাধবের নামের সঙ্গে রাজা যশোপালের নামটি যুক্ত করায় বিগ্রহের নতুন নাম হয় শ্রী শ্রী যশোমাধব। পরবর্তীতে শ্রী শ্রী যশোমাধব কে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠে ধামরাইয়ে শ্রী শ্রী যশোমাধব মন্দির এবং রথযাত্রা ও মেলার সূচনা হয়।

যশোমাধব ঠাকুরের কুষ্ঠিনামা অনুসারে বাংলা ১০৭৯ সালে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১২০৪ সাল পর্যন্ত রথযাত্রা চলে এসেছে। সূচনালগ্নে একটি বাঁশের রথ নির্মাণ করে পণ্ডিত রামজীবন রায় মৌলিক এই রথ উৎসবের প্রচলন করেন ধামরাইয়ে। বাংলা ১২০৪ থেকে ১৩৪৪ সাল পর্যন্ত বালিয়াটির জমিদাররা বংশানুক্রমে ধামরাইয়ে চারটি রথ তৈরি করেন।

বালিয়াটির জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় রথযাত্রা অব্যাহত থেকেছে। ১৩৪৪ সালে রথের ঠিকাদার ছিলেন নারায়ণগঞ্জের স্বর্গীয় সূর্য নারায়ণ সাহা। এ রথ তৈরি করতে সময় লেগেছিল প্রায় এক বছর (বাংলা ১৩৪৩ শ্রাবণ থেকে ১৩৪৪ আষাঢ় পর্যন্ত)। কালিয়াকৈর, সাটুরিয়া, সিংগাইর ও ধামরাইয়ের কাঠশিল্পীরা যৌথভাবে নির্মাণ কাজে অংশ নিয়ে ৬০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট রথটি তৈরি করেন। এ রথটি ত্রিতলা বিশিষ্ট ছিল। রথের ঘোড়া দুটি খোঁদাই করেছিলেন বালিয়াটির যোগেন্দ্র লাল সূত্রধর। এই রথ টানার জন্য ২৭ মণ পাটের কাছি দরকার হতো।

১৩৪৪ সালের রথে ও পূর্বের রথে যে চিত্রকর্ম খোদিত ছিল তা হিন্দু ধর্মের মহাভারত, রামায়ণের ইতিহাস ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলী নিয়ে চিত্রিত ছিল। তাছাড়া পৌরাণিক চিত্রের সাথে সামঞ্জস্য ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপর চিত্রিত ঘটনার দৃশ্যও স্থান পেয়েছিল সেই রথের গায়ে। ধামরাই রথের শিল্পকর্ম একসময় ঢাকা আর্ট কলেজের শিক্ষার্থীদের সিলেবাস ভুক্ত ছিল।

১৯৫০ সালে (১৩৫৬ বঙ্গাব্দ) জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা (আর.পি সাহা) এগিয়ে আসেন। বিখ্যাত সমাজসেবক আরপি সাহা পাক বাহিনীর হাতে অপহৃত (৭ মে, ১৯৭১) হওয়ার আগ পর্যন্ত এই রথ উৎসবের যাবতীয় খরচ বহন করেছেন। ১৯৭১ সালে (বাংলা ১৩৭৭ সালের ২৭শে ও ২৮শে চৈত্র) উপমহাদেশ খ্যাত ধামরাইয়ের ঐতিহ্যবাহী গৌরবময় নিদর্শন ৬০ ফুট উচ্চতার রথটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় পুড়িয়ে দেয়।

বর্তমানে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট্রের চেয়ারম্যান আরপি সাহার নাতি রাজিব প্রসাদ সাহা শ্রী শ্রী যশোমাধব মন্দিরে সহায়তা অব্যাহত রেখেছেন। বাংলাদেশস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের অনুদানে ধামরাইয়ের বর্তমান রথটি ২০১০ সালে নির্মাণ করা হয়।

মন্তব্য ( ০)





  • company_logo