পবিপ্রবি প্রতিনিধি: বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সামুদ্রিক শৈবাল সহযোগে কৃত্রিম খাদ্যের মাধ্যমে কোরাল মাছ চাষে নতুন এক সফলতা ও সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তরের সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিশ প্রকল্পের আওতায় পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) একুয়াকালচার বিভাগ ‘বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে সামুদ্রিক শৈবাল সহযোগে কৃত্রিম খাদ্যের মাধ্যমে কোরাল মাছ চাষ’ উপপ্রকল্পের গবেষণা কার্যক্রম বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার আলীপুরে চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন এই প্রযুক্তির গবেষণায় গবেষকরা দক্ষিণাঞ্চলে মাছ চাষে নতুন এক সফলতা ও সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছেন।
পটুয়াখালীর আলীপুরে চলা নতুন এই গবেষণা উপ-প্রকল্পের প্রধান গবেষক হলেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একুয়াকালচার বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক এবং সহকারী প্রধান গবেষক হিসেবে আছেন ফিশারিজ বায়োলজি এন্ড জেনেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আরিফুর রহমান। উপ-প্রকল্পটির সার্বিক অর্থায়নে রয়েছে মৎস্য অধিদপ্তরের সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিশ প্রকল্প।
মাছ হচ্ছে প্রাণিজ আমিষের অন্যতম প্রধান উৎস। কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং পুষ্টি সরবরাহে মাছ চাষের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা এফএও এর ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায় চাষের ও প্রাকৃতিক উৎসের মাছ মিলিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম। ২০৩০ সনে দেশের বর্ধিত জনগোষ্ঠীর জন্য প্রক্ষেপিত মৎস্য চাহিদা ৬৫ লাখ মেট্রিক টন। প্রক্ষেপিত মৎস্য চাহিদা পূরণে চাষের মাছ অন্যতম ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ঘেরের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে কোরাল মাছের কিছুটা চাষ হয়ে আসছে। এখানে কোরালের খাবার হিসেবে বিভিন্ন ধরনের ছোট মাছ, তেলাপিয়া বা অন্যান্য মাছ ব্যবহার করা হয়। কৃত্রিম খাদ্যের অভাবে কোরাল মাছের চাষ পদ্ধতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি।
কোরাল মাছ বেশ পুষ্টিসমৃদ্ধ। কোরাল মাছে উন্নতমানের আমিষ রয়েছে যা আমাদের শরীরের পেশী গঠন, ক্ষতিগ্রস্ত কোষ মেরামত এবং হরমোন উৎপাদনে সাহায্য করে। কোরাল মাছ ওমেগা-3 ফ্যাটি অ্যাসিডের একটি সমৃদ্ধ উৎস। বিশেষ করে EPA (ইকোসাপেন্টানোয়িক অ্যাসিড) এবং DHA (ডোকোসাহেক্সানোয়িক অ্যাসিড) এর পরিমাণ উল্লেখযোগ্য। এই ফ্যাটি অ্যাসিডগুলি আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমায়, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা উন্নয়ন করে, প্রদাহ কমায় এবং রক্তের চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও কোরাল মাছে ভিটামিন এ, বি১২, ডি ও ই, খনিজ পদার্থ ক্যালসিয়াম, জিংক, লৌহ, আয়োডিন, ফসফরাস এবং সিলেনিয়াম যথেষ্ট পরিমাণে থাকে। এগুলো শরীর গঠন ও বৃদ্ধির কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশে কোরাল মাছের হ্যাচারি না থাকায় গবেষণা কাজে থাইল্যান্ডের হ্যাচারিতে উৎপাদিত কোরাল মাছের পোনা সংগ্রহ করে নার্সারি পুকুরে নার্সিং করার পর মজুদ পুকুরে মজুদ করা হয়। কোরাল মাছ মাংসাশী হওয়ায় নার্সারি পুকুরে মাঝে মাঝে জাল টেনে বেশি বড় পোনাকে আলাদা করা হয়। নার্সারি পুকুরে কোরাল মাছের পোনাকে সামুদ্রিক শৈবাল সহযোগে ৫০ ভাগ আমিষ সমৃদ্ধ কৃত্রিম খাদ্য প্রয়োগ করা হয়। এ সময় কোরালের পোনাকে দেহ ওজনের ২০-৮% কৃত্রিম খাদ্য সরবরাহ করা হয়। দিন-রাতে মোট ৪ থেকে ৬ বার খাবার দেওয়া হয়। ০.২ গ্রামের কোরাল পোনা ৫ গ্রাম ওজনের হলে মজুদ পুকুরে মজুত করা হয়।
এই গবেষণা উপ-প্রকল্পের গবেষকগণ ১ টি গবেষণা কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন। এই গবেষণাতে কৃষকের পুকুরে কোরালের অধিক বৃদ্ধির জন্য কৃত্রিম খাদ্যে সামুদ্রিক শৈবালের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে। এখানে কৃত্রিম খাদ্যে ০% থেকে ২০% হারে সামুদ্রিক শৈবাল প্রয়োগ করে কোরাল মাছকে খাওয়ানো হয়েছে। যেই কৃত্রিম খাবারে ১০% সামুদ্রিক শৈবাল ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে মাছের উৎপাদন বেশি পাওয়া গেছে। আরও ২ টি গবেষণা কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে রয়েছে। দ্বিতীয় গবেষণাতে কোরাল মাছের মজুদ ঘনত্ব নির্ধারণ এবং তৃতীয় গবেষণাতে কোরাল মাছের বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত খাদ্য নির্ধারণে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া পানির গুণাগুণ পরীক্ষা, প্লাংটনের প্রাচুর্যতা, মাছে ও পানিতে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি নিয়ে গবেষকগণ কাজ করছেন।
গবেষণায় দেখা গেছে শতাংশে ২০ টি কোরাল মাছ মজুত করে ১০% সামুদ্রিক শৈবাল সহযোগে কৃত্রিম খাবার ব্যবহারে মাছের উৎপাদন বেশি পাওয়া গেছে। এ সময় কোরাল মাছকে দেহ ওজনের ৬-১% কৃত্রিম খাদ্য সরবরাহ করা হয়। মাছকে ২ বার খাবার দেওয়া হয়। কোরাল মাছ নিশাচর হওয়ায় অর্ধেক খাবার প্রত্যুষে বাকী অর্ধেক খাবার গোধূলিতে প্রয়োগ করা হয়। ৫ গ্রামের কোরাল ১ বছরে ২-৩.৫ কেজি ওজনের হয়েছে যা দক্ষিণাঞ্চলের মৎস্যচাষীগণের কাছে ছিল অকল্পনীয়।
এই গবেষণা উপ-প্রকল্পের মাধ্যমে সুফলভোগীদের মাঝে মাছ চাষের সকল উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ২৫০ জন মৎস্যচাষী প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। উপ-প্রকল্পের সুফলভোগী মো: আনোয়ার হোসেন জানান পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যারদের মাধ্যমে ফিড খাবার খাওয়ানোর মাধ্যমে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস হতে শুরু করে এই বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এক একটি কোরাল ৩.৫ থেকে ৪ কেজি পর্যন্ত হয়েছে। আমি এর মাধ্যমে জানলাম ফিড খাবার খাওয়ানোর মাধ্যমে কোরাল পালা যায়।
এর মাধ্যমে চাষীরা ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হতে পারবে। মৎস্য অধিদপ্তরের সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিশ প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক ড. মোহাম্মদ শরিফুল আজম জানান, থাইল্যান্ডের হ্যাচারিতে উৎপাদিত কোরাল মাছের পোনাকে সিউইড সহযোগে পিলেট খাদ্যের মাধ্যমে চাষ করে ১ বছরে ৩-৩.৫ কেজি হওয়ায় আমরা আশাবাদী। চাষকালীন সময়ে কোরাল মাছের আাকারের তারতম্য খুব বেশি হওয়ায় ছোট মাছগুলোকে কাটাই করে অন্য পুকুরে স্থানান্তর করলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
এ ব্যাপারে উপ-প্রকল্পের প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বাংলাদেশে এই প্রথম সামুদ্রিক শৈবাল সহযোগে কৃত্রিম খাদ্যের মাধ্যমে থাইল্যান্ডের হ্যাচারিতে উৎপাদিত কোরাল মাছের চাষ পদ্ধতি নিয়ে তাঁর দল কাজ করছেন। ৫ গ্রামের কোরাল মজুদ পুকুরে ১ বছরে চাষ করে ২-৩.৫ কেজি ওজনের হওয়ায় শুধু দক্ষিণাঞ্চল নয় পুরো বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মৎস্যচাষীগণের কাছে নতুন এক সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন তাঁদের উদ্ভাবিত সামুদ্রিক শৈবাল সহযোগে কৃত্রিম খাদ্যের মাধ্যমে কোরাল মাছ চাষ প্রযুক্তি বাংলাদেশে কোরাল মাছের উৎপাদন তথা বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের উৎপাদন বাড়াতে ভূমিকা রাখবে।
মন্তব্য ( ০)