• সমগ্র বাংলা

দেশের বৃহৎ পাকশালায় চলছে ১০ লক্ষাধিক মানুষের রান্না

  • সমগ্র বাংলা
  • ১৪ জানুয়ারী, ২০১৯ ১৪:২০:০৩

বৃহৎ পাকশালায় – অতিথি পরায়ন বাঙালির রীতি অনুযায়ী বাড়িতে আত্বীয়-স্বজন এলেই রান্নার ধুম পড়ে যায়। উৎসাহ উদ্দিপনায় চলে আদর-আপ্যায়ন। খাঁচা থেকে মুরগী ধরে জবাই ও বাড়ির পুকুর থেকে জাল দিয়ে ধরা মাছ আর খোঁয়াড়ে থাকা ছাগল জবাই করে চলে রান্নার আয়োজন। মিষ্টি মুখ করাতে নিজেদের গোয়াল ঘরের খাঁটি গরুর দুধ, খেঁজুরের রসের গুড় দিয়ে পিঠা পায়েস না খাওয়ালেই নয়। কালের বিবর্তনে শহরীদের কাছে এসব আয়োজন কিছুটা মলিন হলেও গ্রামীণ জনপদে ঐতিহ্যের এই ধারাবাহিকতা এখনো বিরাজমান। বিশেষ করে উপমহাদেশের ইসলাম প্রচারক প্রখ্যাত সুফী সাধক সিরাজগঞ্জে হযরত শাহ সুফী খাজা বাবা ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী (রঃ) এর এনায়েতপুর পাক দরবার শরীফে আসা দেশ-বিদেশের অতিথি এবং ভক্ত জাকের ভাই-বোনদের জন্য আপ্যায়নে সেই ঐতিহ্যকে লালন করেছে কর্তৃপক্ষ। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর শান্তির বাণী প্রচারের মানবতাবাদী এই দরবার শরীফে এবার ২০১৯ সালের অতীতের মতোই বাৎসরিক ৩ দিনব্যাপী ওরশে ভারতের আসাম থেকে এবং বাংলাদেশের প্রায় ১০ লক্ষাধিক দাওয়াতী ধর্মপ্রাণ মুসুল্লীরা আপ্যায়িত হয়েছে। তাদের আপ্যায়ন করা হয়েছে কুমারদের তৈরি করা মাটির প্রায় লক্ষাধিক থালা বা শানকিতে। দরবারে স্থাপিত দেশের বৃহৎ পাকশালায় ৬শ স্বেচ্ছাসেবী পাচক রন্ধন কাজে দিন-রাত নিয়োজিত ধর্মীয় এ আয়োজন সফল করেছে। জানা যায়, উপমহাদেশের অন্যতম সুফী সাধক ও ইসলাম প্রচারক এবং ভারত-বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ১২শ পীর-আউলিয়ার পথ প্রদর্শক হযরত খাজা বাবা ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী (রঃ) এর ১০৪ তম ৩ দিনব্যাপী ওরশ শরীফ গত ১১ জানুয়ারি শুক্রবার হতে শুরু হয়েছিল। অন্য বছরের আয়োজনকে ছাপিয়ে এবার বেড়েছে এর বর্ণাঢ্যতা। রবিবার আখেরী মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হলেও আরো দুদিন থাকে কার্যক্রম। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য পুর্ন এই ওরশ শরীফে এবার ভারতের আসাম এবং বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন থেকে প্রায় ১০ লাখের মত ভক্তগণের সমাগম হয়। তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনে মসজিদ, মাজার, খাজা এনায়েতপুরী (রঃ) বাসভবনসহ বিস্তৃত এলাকায় করা হয়েছিল সব ধরনের ব্যবস্থা। আগত ভক্ত নারী-পুরুষদের থাকার জন্য এনায়েতপুর মাজার এলাকাসহ পুরো গ্রাম জুড়ে সুবিশাল প্যান্ডেল স্থাপনের পাশাপাশি আপ্যায়নেও গ্রহন করা হয়েছিল বিশেষ আয়োজন। দরবারের ৪টি বিশাল ঘরের পাকশালাতে সর্বক্ষণ চলছে মাছ-মাংস, সবজি, ভাত, ডাল রান্নার কাজ। এখানে তরকারি রান্নার জন্য ৭২টি এবং ৭৪টি চুলায় ভাত রান্নায় স্বেচ্ছাশ্রমে নিয়োজিত রয়েছে ব্যবসায়ী, স্কুল ছাত্র, শ্রমজীবি শিশু বৃদ্ধ থেকে শুরু করে শিল্পপতি শ্রেণির ৬শ মানুষ। যাদের অক্লান্তিক পরিশ্রমে তৈরি সুস্বাদু এসব খাবার। অনুষ্ঠানে অতিথি হয়ে আসা জাকেরদের আপ্যায়নে যেন কোন কিছুর কমতি না থাকে সেজন্য কয়েক মাস আগে থেকেই চাহিদা অনুযায়ী করা হয়েছে এর বাজার সদাই। ওরশে এবার প্রায় ১০ লক্ষধিক ভক্তের খাবারের জন্য ১ হাজার ৫শ মন চাল, মাসকালাই ডাল ২৫০ মন, আলু ১ হাজার ৫শ মন, ২শ মন সরিষার তৈল, ১৪ মন শুকনা মরিচ, ১০ মন হলুদ, লবন ১২৫ মন, জিরা ২মন, রসুন ৭৫ মন, আদা ১০০ মন, ৬ হাজার মন জ্বালানী কাঠ এবং ১ লাখ টাকার অন্যান্য মসলা ব্যবহার করা হয়েছে। পাশাপাশি মাংসের ৩ শতাধিক ছোট-বড় গরু, প্রায় ২ হাজার ছাগল-ভেড়া জবাই করা হয়েছে। এছাড়া শুক্রবারের জন্য ১ ট্রাক মাছ এবং প্রায় ৫শ মন সবজি রান্না হয়েছে। ২শ বড় হাড়িতে হয়েছে এসব রান্না। খাবার পরিবেশন করা হয়েছে প্রায় লক্ষাধিক মাটির থালায় (শানকিতে)। সিরাজগঞ্জে হযরত শাহ সুফী খাজা বাবা ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী (রঃ) এর এনায়েতপুর পাক দরবার শরীফে আসা দেশ-বিদেশের অতিথি ভক্তের আপ্যায়ন। দেশের বৃহৎ এই পাকশালার প্রধান খাদেম হিসেবে নিয়োজিত বৃদ্ধ মোঃ চাঁন শাহ সরকার ও ফটিক সরকার জানান, ‘এবার ওরশে দেশ বিদেশের ভক্তদের অতীতের চেয়ে বেশি আগমন হয়েছে। মুলত তারা খাজা এনায়েতপুরী (রঃ) মাজার জিয়ারত ও ধর্ম সাধনার জন্য আসে। খাজা পীর ইউনুছ আলী (রঃ) এর নির্দেশিত শান্তির পথেই তার ছেলে দরবারের বর্তমান গদ্দিনশীন পীর হযরত খাজা বাবা কামাল উদ্দিন (নুহু মিয়া) জাকেরদের যথাযথ সম্মান ও আপ্যায়িত করে আসছেন। আর এই আতিথিয়তার জন্য আমরা ৬ শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক গত কয়েক দিন ধরে নিয়োজিত রয়েছি। এখানে অনেক পরিশ্রম করলেও আমাদের কিছু মনে হয় না। সবি সৃষ্টিকর্তার অশেষ মেহেরবান।’ এ পাকশালায় স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করা ৬শ মানুষ সবাই নিজ-নিজ কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত। কেউ চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, তাঁত শ্রমিক কেউবা স্কুল কলেজের ছাত্র। ওরশের সময় এলেই তারা নিজ উদ্যোগে এখানে কাজে যোগ দেয়। প্রায় ৪৫ বছর ধরে পাকশালায় কাজ করা রুপনাই গ্রামের তাঁত শ্রমিক মোহাম্মদ আলী মুন্সী, ঢাকায় কর্মরত মুজাহিদ হোসেন এবং এনায়েতপুর গ্রামের ৮ম শ্রেণির ছাত্র মেহেদী হাসান জানান, ‘ওরশের সময় এলেই আমরা যার যার মতো দরবারের পাকশালায় ছুটে যাই। আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি লাভে ইসলামী এই মহাসমাবেশে ভক্তদের মুখে আমরা খাবার তুলে দিতে কাজ করতে পেরে আনন্দিত। এ সময়ে প্রচুর পরিশ্রম করলেও শরীরে ক্লান্তি আসে না। উৎসব মুখর পরিবেশেই সবাই কাজ করে থাকি।’ সিরাজগঞ্জে হযরত শাহ সুফী খাজা বাবা ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী (রঃ) এর এনায়েতপুর পাক দরবার শরীফে আসা দেশ-বিদেশের অতিথি ভক্তের আপ্যায়ন। এদিকে ওরশ শরীফে প্রতিবার আসা ঢাকার যাত্রাবাড়ির বাসিন্দা ভক্ত খোরশেদ আলম ও নরসিংদীর পাঁচদোনার মঞ্জুরুল আলম জানান, ‘ঐতিহ্যের ওরশ শরীফে ২ বেলা খাবার আয়োজন দরবার শরীফই করে থাকে। সেখানে পাকশালার খাবারটা আমরা নিয়ামক হিসেবেই গ্রহন করি। খাবারের যে সুস্বাদ তা কোথাও মেলা ভার। এক কথায় অমৃত। এখানে সৃষ্টিকর্তার অশেষ মেহেরবানীতে কোন মজুরী ছাড়াই স্বেচ্ছাসেবকরা খাবার তৈরি করে থাকে বলেই দেশের বৃহৎ এই পাকশালা সবার কাছে সমাদৃত।’ এদিকে বাংলাদেশ এ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির সহ-সভাপতি প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী এফ.আর সরকার ও একুশে ফোরাম সিরাজগঞ্জের সভাপতি আখতারুজ্জামান তালুকদার বলেন, ‘আমরা সারা দেশ তথা পৃথিবীর অনেক জায়গা ঘুরে বেড়িয়েছি এতো বড় রান্না ঘর কখনো দেখেনি। রান্না ঘরটির বয়স চলছে ১০৪ বছর। যা ঐতিহ্যের অংশ হয়েই বেঁচে রয়েছে।’

মন্তব্য ( ০)





  • company_logo