
নিউজ ডেস্ক : বিশ্ব অর্থনীতির অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগের নিরাপদ মাধ্যম খুঁজতে গিয়ে বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণের বাজারে ঝুঁকছেন। অন্যদিকে গত এক বছরে স্বর্ণের দাম প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বেড়ে বুধবার প্রতি আউন্স তিন হাজার ৫৫০ মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে, যা সর্বকালের সর্বোচ্চ। ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দাম আরও বাড়তে পারে বলে কিছু বিশ্লেষক ধারণা করছেন।
অস্ট্রেলিয়ার কেসিএম ট্রেডের প্রধান বাজার বিশ্লেষক টিম ওয়াটারার কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেন, স্বর্ণকে দীর্ঘদিন ধরেই বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তা বা অস্থিরতার সময়ের জন্য পছন্দের সম্পদ মনে করে আসছেন। কারণ শেয়ারের তুলনায় এর দাম তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল থাকে।
ওয়াটারার আরও বলেন, আর্থিক বাজারের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো অনিশ্চয়তা। আর এমন পরিস্থিতিতে স্বর্ণই সাধারণত ব্যবসায়ীদের ভরসার জায়গা হয়ে ওঠে।
যদিও ঐতিহাসিকভাবে স্বর্ণ সীমিত মুনাফা দিয়েছে, তবু গত দুই বছরে এর দাম দ্রুত বেড়েছে—ইউক্রেন ও গাজায় যুদ্ধ, আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের মতো বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে।
এছাড়া সরকার ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা না রাখা বিনিয়োগকারীরাও সোনা পছন্দ করেন। কারণ এটি এমন একটি পণ্য, যা শারীরিকভাবে নিজের কাছে রাখা ও সংরক্ষণ করা যায়।
কিভাবে স্বর্ণে বিনিয়োগ হচ্ছে
স্বর্ণের বিনিয়োগের দুটি প্রধান উপায় রয়েছে। প্রথমত, সরাসরি স্বর্ণের বার, গলানো স্বর্ণ, গয়না বা মুদ্রা কেনা। দ্বিতীয়ত, আর্থিক পণ্যের মাধ্যমে বেচাকেনা।
বিনিয়োগকারীরা ভবিষ্যৎ চুক্তি (ফিউচার্স) কেনাবেচাও করেন, যেখানে নির্দিষ্ট দামে ভবিষ্যতে স্বর্ণ কেনা বা বিক্রির শর্ত থাকে। এ ছাড়া বিনিয়োগ তহবিলও রয়েছে, যেগুলো স্বর্ণের দামের ওঠানামা অনুসরণ করে।
ব্যক্তি পর্যায়ে সরাসরি স্বর্ণ কেনা সহজ হলেও, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত এসব পণ্য ব্যবহার করে। কারণ এতে তাদের প্রচুর স্বর্ণ হাতে রাখতে বা সংরক্ষণ করতে হয় না।
স্বর্ণের মূল্য সাধারণত মার্কিন ডলারে নির্ধারিত হয় এবং ডলারের সঙ্গে এর সম্পর্ক উল্টো। অর্থাৎ ডলারের মান কমলে স্বর্ণের দাম বাড়ে, আর উল্টোটা ঘটলেও একইভাবে প্রভাব ফেলে।
ট্রাম্প যেভাবে স্বর্ণের দাম বাড়াচ্ছেন
এপ্রিল মাসে ট্রাম্প বিশ্বের বহু দেশের বিরুদ্ধে তার ‘লিবারেশন ডে’ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন। এতে বৈশ্বিক বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। আর তখনই স্বর্ণের দাম হঠাৎ বেড়ে যায়।
এছাড়া সম্প্রতি ট্রাম্প মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ বাড়িয়েছেন, যা দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির ঊর্ধ্বে হিসেবে বিবেচিত হতো। এটিও দাম বাড়ানোর পেছনে ভূমিকা রেখেছে।
আবার ট্রাম্প বারবার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সুদের হার কমাতে চাপ দিয়েছেন অর্থনীতি চাঙা করার উদ্দেশ্যে। তিনি ডলারের মানও কমাতে চান, যাতে মার্কিন রপ্তানি আরো প্রতিযোগিতামূলক হয়।
ক্যাপিটাল ডট কমের সিনিয়র আর্থিক বিশ্লেষক কাইল রডার মতে, এই দুই পরিস্থিতিই স্বর্ণকে বিনিয়োগকারীদের কাছে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
আলজাজিরাকে তিনি বলেন, ‘যদি সুদের হার বাড়ে, তাহলে সোনা কম আকর্ষণীয় হয়। কারণ তখন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মতো সুদযুক্ত সম্পদ থেকে বেশি আয় পাওয়া যায়। কিন্তু সুদের হার কমলে হাতে কম সুদ আসে, তখন সোনা ধরে রাখা তুলনামূলকভাবে বেশি লাভজনক হয়ে ওঠে।’
একই নিয়ম অন্যান্য সুদযুক্ত সম্পদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, যেমন সরকারি বন্ড। রডা আরও বলেন, ডলার দুর্বল হলে বিদেশি মুদ্রায় লেনদেন করা বিনিয়োগকারীরাও বেশি সোনা কেনেন। কারণ তখন তারা একই অর্থে তুলনামূলক বেশি সোনা কিনতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের পরিস্থিতি
অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক অস্থিরতাও স্বর্ণের বাজারকে উসকে দিচ্ছে। ব্রিটিশ পাউন্ড ও জাপানি ইয়েনেও সম্প্রতি ধস দেখা গেছে। যার কারণ মূলত যুক্তরাজ্য ও জাপানের সরকারি অর্থনীতির দুর্বল অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ। জাপানের ক্ষমতাসীন দলে অস্থিতিশীলতার কারণে ইয়েনের ওপর আরও চাপ পড়েছে।
ওয়াটারার বলেন, ‘যখন মুদ্রার মান কমতে থাকে, তখন স্বর্ণ মুদ্রাস্ফীতির ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাওয়ার ভালো সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়। মুদ্রার বিপরীতে স্বর্ণের সরবরাহ সীমিত এবং তাই দামের অবমূল্যায়ন তুলনামূলক কম হয়। তুরস্ক ও মিসরের মতো দেশগুলোর ক্ষেত্রেও বিষয়টি সত্য।’
এছাড়া ট্রাম্পের আমলে বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয়ের জন্য মার্কিন ডলার ধরে রাখা অনেক সরকারের কাছে আগের মতো নিরাপদ মনে হচ্ছে না বলে মনে করেন রডা। ফলে তারা সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ না করে স্বর্ণের দিকে ঝুঁকছে বলে জানান তিনি।
রডা ব্যাখ্যা করেন, ‘সাধারণত একটি দেশ বৈদেশিক বাণিজ্যে অর্জিত ডলার নিরাপদে রাখার জন্য ট্রেজারি বন্ড কেনে, যাতে সুদ পাওয়া যায়। কিন্তু ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি মার্কিন সম্পদ ধরে রাখার ওপর আস্থা কমিয়ে দিয়েছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে। তাই যেসব দেশের হাতে প্রচুর ডলার আছে, তারা সেগুলো দিয়ে স্বর্ণ কিনছে—নিরাপদ সম্পদ হিসেবে। এর ফলে স্বর্ণের দাম আরও বেড়ে যাচ্ছে।’
মন্তব্য (০)