লাইফস্টাইল ডেস্কঃ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন প্রতি বছর ১০ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী ‘বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ পালন করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর প্রায় ৮ লাখ নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করেন। অর্থাৎ প্রতি ৪০ সেকেন্ডে ১ জন নারী বা পুরুষ আত্মহত্যা করছেন। এ লেখাটি যখন পাঠক পড়ছেন, তখন হয়তো ১০ জন আত্মহত্যা করে ফেলেছেন আর প্রায় ৪০ জনের ঊর্ধ্বে আত্মহত্যার চেষ্টা করছেন। প্রতি বছরই এ হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সাধারণত দরিদ্র দেশগুলোতে আত্মহত্যার হার বেশি হলেও উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে জাপানে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি।
বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন (১ মিলিয়ন=১০ লাখ) ডিপ্রেশনের রোগী রয়েছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ৫ জনের ১ জন কোনো না কোনো ধরনের ডিপ্রেশনে ভুগছেন। পরিবারে অনেকে আছেন জানেন-ই না যে তাদের স্বজন ডিপ্রেশনে আছেন। ডিপ্রেশন সম্পর্কে অজ্ঞ, অসচেতনতা প্রচুর।
ডিপ্রেশনের ভয়াবহ দিকটি হচ্ছে— রোগী নীরবে-নিভৃতে আত্মহত্যা করে। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সি তরুণ-তরুণীর মৃত্যুর অন্যতম কারণ এই ডিপ্রেশনজনিত আত্মহত্যা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ সালে দেশে আত্মহত্যা করেছে ১০ হাজারের বেশি মানুষ। বিবিএসের জরিপ বলছে, বাংলাদেশে বছরে আত্মহত্যা করছেন প্রায় ১৩ হাজার মানুষ। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে ঝিনাইদহে।
হঠাৎ করে আত্মহত্যার কারণঃ
সাধারণত টিনএজ বয়সিদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। আত্মহত্যার পেছনের অন্যতম কারণ— ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা রোগ, একাকীত্ব, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, দারিদ্র্যতা, সামাজিক বৈষম্য, বেকারত্ব, দাম্পত্য কলহ, সম্পর্কে টানাপোড়েন, অভাব-অনটন, দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক, মানসিক রোগ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব-কলহ, মাদকাসক্তি, প্ররোচনা, হঠাৎ রেগে গিয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণ হারানো, দৈহিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন।
আত্মহত্যা করার চেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করার পরিসংখ্যান বহুগুণ বেশি। কেউ একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করলে, আত্মহত্যার কথা বললে কিংবা আত্মহত্যার চিন্তা করলে তার মধ্যে এ দুর্ঘটনা ঘটানোর শঙ্কা অনেক অনেক বেশি থাকে। তাই এ লক্ষণ থাকলে তা অবশ্যই গুরুত্বের সাথে নিতে হবে এবং সাইকিয়াট্রিস্ট বা সাইকোলজিস্টের শরণাপন্ন হতেই হবে।
ডিপ্রেশনজনিত আত্মহত্যা কী?
ডিপ্রেশন একটি ভয়ানক মানসিক ব্যাধি। মানুষের শারীরিক-মানসিক কর্মক্ষমতা, দক্ষতা কমে যায় এই ডিপ্রেশনে। ডায়াবেটিস ও হাইপ্রেশারের রোগীর মধ্যে যেমন ডিপ্রেশন দেখা দেয়, তেমনি উল্টোটাও হয়ে থাকে । ডিপ্রেশন যে কারোরই দেখা দিতে পারে। কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, সন্তানসম্ভবা কিংবা প্রসূতি যে কারোরই ডিপ্রেশন হতে পারে, যা থেকে তারা একপর্যায়ে আত্মহত্যা করতে পারেন।
ডিপ্রেশন কাদের হতে পারে?
যে কারোরই ডিপ্রেশন হতে পারে। বিশ্বের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি ডিপ্রেশনের রোগী ছিলেন। তাদের মধ্যে চাঁদে ভ্রমণকারী এডুইন অলড্রিন, প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন, লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, উইস্টন চার্চিল, বিখ্যাত ‘হেরি পোর্টার’-এর লিখিকা জেকে রওলিং, গ্রেমি অ্যাওয়ার্ড খেতাবপ্রাপ্ত গায়িকা শেরিল ক্রো, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোরের স্ত্রীর নাম উল্লেখযোগ্য।
মার্কিন নভোচারী অলড্রিনের দাদিও ডিপ্রেশনের রোগী ছিলেন, যিনি এ নিয়ে আত্মহত্যা করেন। হ্যারি পোর্টারের লেখিকা রোওলিং ডিপ্রেশনের জন্য মাঝেমধ্যে আত্মহত্যার কথা ভাবতেন। তবে তারা সবাই নিয়মিত সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে আলোচনা করতেন।
ডিপ্রেশনের কিছু লক্ষণঃ
♦ সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকা, উৎসাহ-উদ্যম হারিয়ে ফেলা
♦ ঘুম কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া
♦ রুচি কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া, ওজন কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া
♦ কাজকর্মে শক্তি না পাওয়া, মনোযোগ হারিয়ে ফেলা
♦ মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া
♦ নিজেকে নিঃস্ব অপাঙক্তেয় মনে করা
♦ আত্মহত্যার কথা বলা, ভাবা, চেষ্টা করা
এ লক্ষণগুলো টানা দুই সপ্তাহের বেশি থাকলে আমরা তাকে মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসওয়ার্ডারের রোগী বলি। এবং তাকে আত্মহত্যার ঝুঁকিতে আছেন বলা যায়।
চিকিৎসাঃ
সাইকিয়াট্রিস্টের তত্ত্বাবধানে থেকে নানান প্রকারের কার্যকরী এন্টিডিপ্রেসেন্ট ড্রাগ, সাইকোথেরাপি ও কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে একজন ডিপ্রেশনের রোগীকে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ করে তোলা সম্ভব। সাধারণত সারট্রালিন, এমিট্রিপটাইলিন, সিটালোপ্রাম, এস-সিটালোপ্রাম, মিরটাজাপিন এন্টিডিপ্রেসেন্ট হিসেবে খুবই কার্যকরী।
সারা বিশ্বে ক্রমবর্ধমান ডিপ্রেশনের এই ভয়াবহতা উপলব্ধি করেই ২০১৭ সালের ও বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের স্লোগান করা ছিল— “ডিপ্রেশন: লেট'স টক" অর্থাৎ ‘আসুন, ডিপ্রেশন নিয়ে আলোচনা করি’। ডিপ্রেশন নিয়ে লজ্জা নয়। বিষণ্নতা নিয়ে সচেতনতা প্রয়োজন। বিষণ্ন রোগীর প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিন, তাদের সঙ্গে ডিপ্রেশন নিয়ে আলাপ করুন, এবং তাদের চিকিৎসার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিন।
মন্তব্য ( ০)