
খুলনা প্রতিনিধি : খুলনায় মাত্র ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে তিনটি পৃথক হত্যাকাণ্ড এবং এক যুবককে গুলিবিদ্ধ করার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় খুনের মোটিভ চিহ্নিত হলেও এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে প্রকৃত হত্যাকারীরা। একের পর এক সংঘটিত এ ধরনের ঘটনায় নগরবাসীর মধ্যে চরম নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে।
গত ১ আগস্ট রাতে খুলনা মহানগরীর সোনাডাঙ্গা থানার সবুজবাগ এলাকায় নিজ বাড়িতেই দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে খুন হন মনোয়ার হোসেন টগর (২৮)। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার রাতে ৭ জন দুর্বৃত্ত ৩টি মোটরসাইকেলে এসে টগরের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ে। পরিচিত হওয়ায় টগর বাইরে বেরিয়ে আসেন এবং ৫ মিনিট কথাবার্তার এক পর্যায়ে বুকে ছুরিকাঘাত করা হয় তাকে। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়।
পরিবারের দাবি, টগর খুলনার আলোচিত সন্ত্রাসী গ্রেনেড বাবুর ‘বি কোম্পানি’র সদস্য ছিলেন। পরে তিনি পলাশ-কালা লাভলু গ্রুপে যোগ দেন। মাদকের একটি লেনদেন সংক্রান্ত বিরোধেই তার এই পরিকল্পিত হত্যা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সিসিটিভি ফুটেজে সন্দেহভাজনদের শনাক্ত করলেও পুলিশ এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
একই রাতে দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুর গ্রামে খুন হন ভ্যানচালক আলামিন সিকদার (৩৫)। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, আলামিন তার স্ত্রী রিপা বেগমকে বিয়ে করেন তার প্রথম স্বামী আসাদুলের সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর। ধারণা করা হচ্ছে, এই বিবাহজনিত বিরোধের জের ধরেই আসাদুল ও তার সহযোগীরা ঘর থেকে ডেকে নিয়ে নির্মমভাবে খুন করে আলামিনকে।
আসাদুলকে প্রধান আসামি করে নিহতের ভাই ফারুক সিকদার থানায় মামলা দায়ের করেন। আসাদুল পলাতক রয়েছে।
রোববার (০৩ আগস্ট) রাত ৮টার দিকে খুলনার ২ নম্বর কাষ্টমঘাট এলাকায় একটি সেলুনের সামনে অবস্থানরত যুবক সোহেলকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে সন্ত্রাসীরা। তারা চারটি মোটরসাইকেলে এসে, হেলমেট ও মুখ ঢাকা অবস্থায় হামলা চালায়। গুলি সোহেলের পেটে লাগে। স্থানীয়রা দ্রুত উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে।
ঘটনার পরও এখন পর্যন্ত থানায় কোনো মামলা হয়নি।
একই রাতে দৌলতপুর থানার মহেশ্বরপাশা এলাকায় মোটরসাইকেলে চলন্ত অবস্থায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয় ঘের ব্যবসায়ী আলামিনকে (৪০)। ঘটনাটি ঘটে রাতে একটি অন্ধকার সড়কে, যেখানে সিসিটিভি ক্যামেরাও অচল ছিল। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত কোনো অস্ত্র বা আলামিনের মোবাইল ফোন এখনো উদ্ধার করা যায়নি।
পুলিশ জানিয়েছে, আলামিন কয়েক মাস আগে বাদামতলায় ভাড়া বাড়িতে উঠে ঘের ব্যবসা শুরু করেন। হত্যার কারণ নিয়ে তদন্ত চলছে।
একাধিক হত্যাকাণ্ড ও গুলির ঘটনায় খুলনা শহরে সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর অনেক চিহ্নিত সন্ত্রাসী জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। কিন্তু প্রশাসন তাদের ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে। অস্ত্র উদ্ধার হয়নি, পুলিশ কার্যক্রমও অনেক ক্ষেত্রে দায়সারা মনে হচ্ছে। তিনি দাবি করেন, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান এবং বিচারব্যবস্থার কঠোরতা ছাড়া এই পরিস্থিতির উন্নতি অসম্ভব।
এদিকে এসব ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। কেএমপির মিডিয়া ও জনসংযোগ বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার খন্দকার হোসেন আহম্মদ বলেন, এসব হত্যাকাণ্ড মূলত টার্গেট কিলিং। আমরা বারবার গ্রেপ্তার করি, আদালতে পাঠাই। কিন্তু বিচার বিভাগের নমনীয়তায় তারা জামিনে বেরিয়ে এসে পুনরায় অপরাধে জড়ায়। একা পুলিশের পক্ষে এটা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।
তিনি আরও বলেন, রাতের শহরে নিরাপত্তা জোরদার করতে কেএমপি কমিশনারের নেতৃত্বে চেকপোস্ট, টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
খুলনার সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডগুলোর ধরন স্পষ্টতই পরিকল্পিত এবং সুনির্দিষ্ট টার্গেটকেন্দ্রিক। অথচ এসব ঘটনায় আসামিরা ধরা না পড়ায় সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। পুলিশের পাশাপাশি বিচার বিভাগের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন নাগরিক সমাজ।
নগরবাসীর একটাই প্রত্যাশা—অপরাধী যেই হোক, যেন থাকে না কেউ আইনের ঊর্ধ্বে।
মন্তব্য (০)