কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ বাড়ির উঠানে একটা পিঁড়ি নিয়ে বসে ছিলেন রাশেদা বেগম। পাশে বাঁশের ছোট-বড় টুকরি, ডালি বানানোর উপকরণ। আর এগুলো বানাতে তাকে সাহায্য করছেন স্বামী দেলদার হোসেন। এভাবে ছোট কাজে সামান্য আয়ে চলছিল রাশেদার সংসার। কিন্তু ২০২২ সালে সিএনবি প্রকল্পের আর্থিক সহযোগিতায় ভাগ্য বদল হয়েছে রাশেদার।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, উপজেলার তবকপুর ইউনিয়নের মন্ডলপাড়া গ্রামে বাড়ির উঠানে বসে বাঁশের ডালি তৈরি করছেন রাশেদা বেগম। তৈরিকৃত এসব ডালি খুচরা ও জেলার অনেক পাইকার বিক্রেতারা এসে পাইকারি দামে রাশেদার কাছ থেকে নিয়ে যান এসব পণ্য। ছোট ব্যবসা হলেও এসব বিক্রি করে খরচ বাদে প্রতি মাসে রাশেদা বেগম আয় করেন প্রায় ১৫ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে চলছে পুরো সংসার। চলছে ছেলে-মেয়েদের লেখাপাড়াও। জানা গেছে, গৃহিনী রাশেদা বেগম (৪১) এর স্বামী দেলদার হোসেন পেশায় একজন দিনমজুর। তিন ছেলে, দুই মেয়ে নিয়ে সাত জনের পরিবার রাশেদার।
দিনমজুরীর পাশাপাশি বাঁশের কাজ করে স্বামী যা উপার্জন করতেন তা দিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ করা কষ্টকর। পর্যাপ্ত তহবিল না থাকায় বাঁশের কাজটিও ঠিকমত করতে পারতেন না। অর্থের অভাবে রাশেদার বড় মেয়ে শান্তনা আক্তারের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। ২০২২ সালের শেষের দিকে আরডিআরএস বাংলাদেশ কর্তৃক বাস্তবায়িত চাইল্ড, নট ব্রাইড (সিএনবি) প্রকল্পের জরিপে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুর পরিবারের তালিকায় নাম অর্ন্তভুক্ত হয় রাশেদার পরিবারের। এরপর ৪ দিনের দ্রুত আয়বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ পান তিনি। প্রশিক্ষণে পছন্দের ব্যবসার তালিকায় পরিবারের পুরনো ব্যবসা বাঁশের ডালি তৈরী নির্বাচন করেন রাশেদা। প্রশিক্ষণ শেষে ব্যবসা শুরুর জন্য প্রকল্প থেকে প্রথম ধাপে ১২ হাজার ও ২য় ধাপে ৫ হাজার সর্বমোট ১৭ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়। রাশেদা স্বামীকে নিয়ে নিজেদের পুরনো ব্যবসাটিকে নতুন করে শুরু করেন। একসময় পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাওয়া বড় মেয়ে শান্তনা আক্তার বর্তমানে ৮ম শ্রেণীতে পড়াশোনা করছেন। এছাড়াও দুই ছেলে ও এক মেয়ে নুরাণী মাদ্রাসায় পড়াশোনা করছেন। একটা সময় অর্থাভাবে ছেলেমেয়েদের পুষ্টিকর খাবার দিতে না পারা রাশেদা বেগম এখন সন্তানদের বাড়িতে পালন করা মুরগীর ডিম ছাড়াও সপ্তাহে একদিন হলেও মাছ-মাংস খাওয়ানোর চেষ্টা করেন।
এলাকায় নারী ব্যাপারী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া রাশেদা বেগমের কাছে এলাকার অন্য নারীরা আসেন বিভিন্ন পরামর্শ নিতে। তাদের সকলকেই অন্য সকল বিষয়ের পাশাপাশি সন্তানদের বাল্যবিয়ে না দিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সহায়তা করার পরামর্শ দেন তিনি। রাশেদা বেগম বলেন, অভাবের সংসারে মেয়ে তখন ৫ম শ্রেণিতে পড়ে। অভাবের তাড়নায় মেয়ের বিয়ের চেষ্টা করতেছি এমন খবর পায় তবকপুর ইউনিয়ন যুব সংগঠন। তাদের সহায়তার আরডিআরএসের সিএনবি প্রকল্পে প্রশিক্ষণ নিই। এরপর তারা ১৭ হাজার টাকা দেয়। এখন আমার সংসারে আর অভাব নেই। রাশেদা আরও বলেন, বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন করি। যে আয় হয় তাতে সংসার ও চিকিৎসা খরচ ছাড়াও ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে পারছি। ভালো-মন্দ খেতে পারছি। প্রতি মাসে কিছু টাকা সঞ্চয়ও করতে পারছি। মেয়ে স্থানীয় একটি স্কুলে ৮ম শ্রেণিতে পড়ছে। অল্প বয়সে বিয়েতে তার আগ্রহ নাই। পড়াশোনা শেষের আগে মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার কোন চিন্তা নাই।
রাশেদার এমন ঘুরে দাঁড়ানো এবং মেয়েকে সম্ভাব্য বাল্যবিয়ের ঝুঁকিমুক্ত করার পেছনে সহায়ক শক্তি ছিল প্লান ইন্টারন্যাশনাল ও আরডিআরএসের সিএনবি প্রকল্প। সিএনবি প্রকল্পের কো-অর্ডিনেটর আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, কুড়িগ্রাম বাল্যবিয়ের ঝুঁকিপূর্ণ জেলা। এখানে বাল্যবিয়ের অন্যতম প্রধান কারণ দরিদ্রতা। রাশেদার মতো হাজারো পরিবারে বাল্যবিয়ের ঝুঁকিপূর্ণ শিশু রয়েছে। তাদের স্বাবলম্বী করতে সিএনবি প্রকল্পে এমন এক হাজার ২০০ পরিবারকে আয়বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণের পর আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এর প্রথম ও প্রধান শর্ত ছিল পরিবারগুলো যেন মেয়ে শিশুর পড়াশোনা চালিয়ে নেন এবং বাল্যবিয়ে না দেন। এতে করে ওই পরিবারগুলো আর্থিক সচ্ছলতা নিয়ে দরিদ্রতা জয় করছে। মেয়ে শিশুর পড়াশোনা চালু রাখছে, অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া থেকে বিরত থাকছে।
মন্তব্য (০)