
নিউজ ডেস্কঃ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য আঞ্চলিক সংলাপ এখন সময়ের দাবি বলে আইপিজিএডি ওয়েবিনারে জানিয়েছেন বক্তারা। দ্য ইনস্টিটিউট ফর পলিসি, গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট আয়োজিত গ্লোবাল ডিসকোর্স সিরিজ-এর সর্বশেষ পর্বে রোববার অনুষ্ঠিত হয়েছে ভার্চুয়াল আলোচনা।
'নেপালের বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট: দক্ষিণ এশিয়া ও বৈশ্বিক পরিসরে এর প্রভাব' শিরোনামের এ ওয়েবিনারে অংশ নেন বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও যুক্তরাজ্যের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, কূটনীতিক ও নীতিবিশেষজ্ঞরা। আলোচনায় উঠে আসে —নেপালের এই অস্থিরতা হয়তো আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য, বাণিজ্য, এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কাঠামোতে নতুন মাত্রা সংযোজন করছে।
ওয়েবিনারটির উদ্বোধনী বক্তব্য দেন এমডব্লিউআরসি মালয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট ও আইপিজিএডি চেয়ারম্যান, ড. ইশারফ হোসেন। তিনি বলেন, নেপালের এই রাজনৈতিক সংকট একক কোনো ঘটনা নয়, এটি এমন এক ভূরাজনৈতিক সঙ্কটবিন্দুতে অবস্থিত, যেখানে ভারত ও চীনের কৌশলগত প্রভাব সরাসরি মুখোমুখি। তাঁর মতে, ২০০৮ সালে নেপালের রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরের সময় ভারতের দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থান চীনের জন্য সুযোগ তৈরি করে দেয়, যার ফলশ্রুতিতে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ -এর মাধ্যমে চীনের প্রভাব দ্রুত বিস্তৃত হয়। নেপালে যা ঘটে, তা নেপালেই থেমে থাকে না, বলেন ড. হোসেন এর প্রতিক্রিয়া পড়বে আঞ্চলিক বাণিজ্যপথ, সীমান্ত রাজনীতি এবং কৌশলগত আস্থার ওপর।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রফেসর ড. যুবরাজ সাংরৌলা, অধ্যাপক এমেরিটাস, কাঠমান্ডু স্কুল অব ল ও নেপালের সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি তুলে ধরেন নেপালের রাজনীতিতে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার বহুমুখী প্রভাব, যা একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে নীতি প্রণয়নের স্তরে। তিনি উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত এমসিসি প্রকল্পে নেপালের যোগদান দেশের রাজনীতিতে প্রজন্মগত বিভাজন তৈরি করেছে—একদিকে প্রবীণ নেতৃত্ব, অন্যদিকে তরুণদের নতুন চিন্তা। তাঁর মতে, ভারতীয় গণমাধ্যমের অতিরঞ্জিত প্রতিবেদন নেপালের আন্দোলন-পরবর্তী পরিস্থিতি আরও বিভ্রান্ত করেছে।
বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন প্রফেসর ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান, ভিসি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা ও পারস্পরিক বোঝাপড়া জোরদারে সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করা এখন সময়ের দাবি। তিনি চারটি নীতি অগ্রাধিকারের কথা তুলে ধরেন—জবাবদিহিতা, যুব কর্মসংস্থান, জলবায়ু সহনশীলতা, এবং ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক অবস্থান। তাঁর মতে, বিশ্বাস ও যৌথ দায়িত্ববোধ ছাড়া কোনো অঞ্চল টেকসই অগ্রগতি অর্জন করতে পারে না।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. শাফাত আহমদ, প্রিন্সিপাল রিসার্চ ফেলো, এফএসডিএস, এবং মুহাম্মদ আমির রানা, প্রেসিডেন্ট, পাকিস্তান ইনস্টিটিউট ফর পিস স্টাডিজ, বলেন, নেপালের এই অস্থিরতা পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর জন্য এক সতর্ক সংকেত, বিশেষত যেখানে রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতা ও দুর্বল শাসনব্যবস্থা ইতিমধ্যেই বিদ্যমান।
আলোচনায় ড. জিশান হাশিম, এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, প্রিসা (লন্ডন) ও গবেষক, ইউরোপিয়ান রিসার্চ ইউনিভার্সিটি, বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন রাজনৈতিক সংগঠনের এক নতুন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। তিনি ব্যাখ্যা করেন, অনলাইন আন্দোলনের শক্তি তার- কম ব্যয়, আবেগনির্ভরতা, বিকেন্দ্রীভূত গঠন ও অ্যালগরিদম-চালিত প্রসারের মধ্যেই নিহিত। এটা আর শুধু আঞ্চলিক নয়, তিনি বলেন, এটা বৈশ্বিক এক পরিবর্তন—যেখানে মানুষ নতুনভাবে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের দাবি তুলছে, যখন সরকার তাদেরকে ন্যায্য গুরুত্ব দেয় না।
বিশেষ অতিথি হিসেবে বাংলাদেশের নেপালস্থ রাষ্ট্রদূত মো. শফিকুর রহমান বলেন, নেপালের সাম্প্রতিক আন্দোলনের গতি ছিল অভাবনীয়—মাত্র ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, পরিবর্তনের দাবি তোলে, এমনকি অনেকে প্রশ্ন তোলে, কেন বিদেশি দূতাবাসগুলো তখনও খোলা। তাঁর ভাষায়, এটা শুধু রাজনীতি ছিল না—এ ছিল সামাজিক সংহতির প্রতিফলন, শ্রেণিসংঘাতের প্রকাশ, একপ্রকার দ্বন্দ্বমূলক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। উপস্থিত ছিলেন ড. রাজ কে. সন্দু, সহকারী অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব জম্মু, ভারত, এবং ড. নূর মোহাম্মদ সরকার, সহকারী অধ্যাপক, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি। তাঁরা সীমান্ত পেরিয়ে নীতি-গবেষণায় সমন্বয় বৃদ্ধির আহ্বান জানান।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন মো. মোস্তফা হোসেন, সহকারী অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও সম্মানসূচক গবেষণা পরিচালক, আইপিজিএডি।
ওয়েবিনারের সমাপনী বক্তব্য ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন আলাউদ্দিন মোহাম্মদ, নির্বাহী পরিচালক, আইপিজিএডি। তিনি বলেন, আজকের আলোচনার প্রশ্নগুলো কাঠমান্ডুর সীমানা ছাড়িয়ে ধ্বনিত হয়েছে ঢাকা, ইসলামাবাদ, কলম্বো ও নয়াদিল্লির রাজপথেও—যেখানে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও জনমুখী অস্থিরতা একসঙ্গে কাজ করছে। আমরা শুধু নেপালের সংকট নয়, দক্ষিণ এশিয়ার গণতন্ত্রগুলোর অন্তর্নিহিত দুর্বলতাও দেখেছি। হয়তো এখন প্রশ্নটা হচ্ছে পরবর্তী আলোচ্য দেশটি কে?
মন্তব্য (০)