
নিউজ ডেস্ক : লেখক-গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বামপন্থি রাজনীতিক ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর আর নেই (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)। রোববার সকাল ১০টা ৫ মিনিটে রাজধানীর শ্যামলীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতার ভুগছিলেন তিনি।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, গত প্রায় এক মাস ধরেই তিনি অসুস্থ ছিলেন। এই সময়ে তাকে হাসপাতালে নিতে হয়েছে একাধিকবার। রোববার সকালে অসুস্থ হয়ে পড়লে আবার তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে রেখে গেছেন। ছোট মেয়ে সারা আকতারই বদরুদ্দীন উমরের দেখাশোনা করতেন এবং বড় মেয়ে লন্ডনে থাকেন। আজ তার দেশে ফেরার কথা।
বদরুদ্দীন উমরের ছেলে সোহেল আব্দুল্লাহ জানান, তার লাশ সোমবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হবে। রোববার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে তার লাশ ফ্রিজিং গাড়িতে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। সোমবার সকাল ১০টায় লাশ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হবে। পরে জুরাইন কবরস্থানে দাদার কবরের পাশে সমাহিত করা হবে বাবাকে। বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও উপদেষ্টারা শোক জানিয়েছেন। বদরুদ্দীন উমর ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর ভারতের বর্ধমানে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আবুল হাশিম ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের একজন মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ। ষাটের দশকে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে তার লেখা বইগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তার চিন্তার গভীরতার স্বাক্ষর ধরে রেখেছে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ (১৯৬৬), ‘সংস্কৃতির সংকট’ (১৯৬৭), ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ (১৯৬৯), পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলাদেশের কৃষক, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশসহ বিভিন্ন গ্রন্থ। বদরুদ্দীন উমর ১৯৬১ সালে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে পিপিই ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৬৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। গভর্নর মোনায়েম খানের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের প্রতিবাদে ১৯৬৮ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে রাজনীতি ও লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন। তার লেখা ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ ভাষা আন্দোলনের ওপর প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগ্রন্থ। চিরকালের আপসহীন এই চিন্তাবিদ দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব স্বাধীনতার পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বাংলা একাডেমি পুরস্কারও তিনি গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান।
বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি ও গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী ছিলেন তিনি।
একসময় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছিলেন বদরুদ্দীন উমর। ২০০৩ সালে তিনি জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল নামে একটি সংগঠন গড়ে সভাপতির দায়িত্ব নেন।
এক শোকবার্তায় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে পেশাজীবন শুরু করে পরবর্তীতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে যোগ দেওয়া বদরুদ্দীন উমর ছিলেন আমাদের মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতির সংগ্রামের এক উজ্জ্বল বাতিঘর। ভাষা আন্দোলনে তার সক্রিয় ভূমিকা, গবেষণা, ঔপনিবেশিক মানসিকতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ এবং সমাজতান্ত্রিক দর্শনের প্রতি তার অবিচল নিষ্ঠা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরাচারী সরকারের পরিবর্তনের জন্য গোড়া থেকেই গণ-অভ্যুত্থানের কথা বলেছেন এবং জুলাই আন্দোলনকে উপমহাদেশের একটি অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি দিয়েছেন। প্রফেসর ইউনূস বলেন, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর শুধু একজন তাত্ত্বিক ছিলেন না, ছিলেন একজন সংগ্রামী, যিনি আজীবন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন। তার মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি আর আবরার, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম। বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শোকবাণীতে দুই শীর্ষ নেতা বলেন, বদরুদ্দীন উমর ব্রিটিশ ভারতের খ্যাতনামা রাজনীতিক আল্লামা আবুল হাশিমের সন্তান ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করেন। জীবদ্দশায় তাকে ইতিহাসে রাজনৈতিক জীবন্ত কিংবদন্তি বলা হতো। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের ইতিহাস তৈরিতে তিনি ছিলেন বিদ্যাপীঠসম। সর্বশেষ স্বৈরাচারবিরোধী জুলাই আন্দোলনে তার তাত্ত্বিক অবস্থান নতুন প্রজন্মকে দিয়েছে মুক্তির এক নতুন দিশা।
গভীর শোক ও বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-সিপিবির (এম) সভাপতি কমরেড ডা. এম এ সামাদ ও সাধারণ সম্পাদক কমরেড সাহিদুর রহমান।
মন্তব্য (০)