
পাবনা প্রতিনিধিঃ মাছের রাজ্য চলনবিল। একসময় নাকি গৃহিণী চূলায় ভাতের হাঁড়ি তুলে দিতো আর গৃহকর্তা বিলে গিয়ে খেয়াজালে মাছ ধরে আনতো। ভাত রান্না শেষ হতে না হতেই মাছ রান্নার আয়োজন শেষ হতো-এসবই এখন যেন রুপকথা। এই রুপকথাকে বাস্তবে পরিণত করতে পারলে ফের মাছের রাজ্যে পরিণত হবে চলনবিল। কিন্তু নিষদ্ধ কারেন্ট জাল, চায়না দুয়ারি জাল, বাদাই জাল দিয়ে অবাধে মাছ শিকারের পাশাপাশি জমিতে অতিরিক্ত কীটনাশকই মাছের সর্বনাশ ডেকে আনছে। লোপ পাচ্ছে মাছের প্রজনন ক্ষমতা।
মাছের প্রজননকালে দেদারছে মা ও পোনা মাছ নিধন করা হয়। ফলে চলনবিলের দেশী মাছের সর্বনাশ হচ্ছে। বিলুপ্ত হচ্ছে অনেক প্রজাতির দেশী মাছ। মাছের আকাল যেন চলনবিলে লেগেই আছে। মিঠা পানির সুস্বাদু মাছ পাওয়াই দুষ্কর। এদিকে সময়মতো বিলে পানি না আসায় মাছের প্রজনন সময় বিলম্ব হচ্ছে। দেদারছে অপরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন উপকরণে মাছ ধরার কারণে চলনবিলে জীববৈচিত্র্যও পড়েছে হুমকির মুখে।
চলনবিল এলাকায় চায়না দুয়ারি, কারেন্ট জাল ও বাদাই জাল দিয়ে পানি থেকে ছেঁকে তোলে মাছসহ অসংখ্য ক্ষুদে জলজপ্রাণি। যার কারণে মাছ সমুলে ধ্বংস হচ্ছে। প্রজননকালে মাছেরা যে সকল ক্ষুদে জলজপ্রাণি মাছের খাদ্য হিসাবে গ্রহন করে সেগুলো ধ্বংস হওয়ায় প্রজনন সংকটও তৈরি হচ্ছে।
এবারও বিলে পানি এসেছে বিলম্বে। পানি আসার সাথে সাথে মাছ নিধনে মেতে ওঠে বিলপাড়ের সৌখিন মৎস্য শিকারীরা। পাশাপাশি জেলেরা বসে থাকেনি। তারাও মাছ ধরার রকম রকম উপকরণ নিয়ে নেমে পড়ে বিলে। এ কারণে বিলের দেশী মাছের প্রজননসহ বেড়ে ওঠায় সৃষ্টি হয় প্রকিবন্ধকতা। এ অবস্থায় চলনবিল অঞ্চলের দেশী মাছ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় মাঠে নামে চাটমোহর উপজেলা প্রশাসন ও মৎস্য দপ্তর। শুরু হয় নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল,চায়না দুয়ারি জাল,বাদাই জালের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান।
চলনবিল অঞ্চলের বৃহৎ উপজেলা চাটমোহর। এই উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মুসা নাসের চৌধুরী ও সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল মতিন নিষিদ্ধ জালের বিরুদ্ধে চলতি মৌসুম শুরু হওয়ার সাথে সাথে অভিযানে নামেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন বিল ও জলাশয়ে অভিযান চালিয়ে জব্দ করা হয় হাজার হাজার চায়না দুয়ারি ও কারেন্ট জাল। ইতোমধ্যে অন্ততঃ ১০টি অভিযানের মাধ্যমে কোটি টাকারও বেশি চায়না দুয়ারি ও কারেন্ট জাল জব্দ করে ধ্বংস করা হয়েছে। চলনবিলের অন্যান্য উপজেলাতেও চায়না দুয়ারি জালের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে।
সরেজমিনে চাটমোহর উপজেলার নিমাইচড়া এলাকার আব্দুল মালেক বলেন, প্রতি বছর আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বিলের পানি আসার সাথে সাথে প্রচুর টেংরা, পুঁটি, খলসে, বাতাসি, চেলা, মলা, টাকি, বাইম, শোল, বোয়াল, গজার, মাগুর, শিং, কৈসহ নানা প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। দামও কম থাকে। এসময়টা মাছ ধরা বন্ধ রাখা হলে চলনবিলে পানি আর মাছ সমান হয়ে যাবে। কিন্তু কেউ তা মানছেনা। মা ও পোনা মাছ নিধন চলে অবাধে। প্রশাসনও থাকে অনেকটা নীরব। কিন্তু এবছর দেখছি চায়না দুয়ারি জালের বিরুদ্ধে ইউএনও স্যার প্রায় দিনই অভিযান চালাচ্ছেন। অনেকেই এখন আর জাল পাঁততে ভয় পাচ্ছেন। এ অভিযান আব্যাহত রাখা দরকার বলে জানান তিনি।
ছাইকোলা এলাকার সিদ্দিকুর রহমান বললেন, দুই/তিন মাস মাছ ধরা বন্ধ রাখতে পারলেই চলনবিল মাছে ভরে উঠবে। কিন্তু তার জন্য সবার আন্তরিকতা দরকার। পানি আসার সাথে সাথে তো মানুষ বিলের সুস্বাদু ছোট মাছ চায়। তাইতো মাছ ধরা হয়।
মৎস্যজীবি সুশীল হলদার বললেন, আমরা যদি মাছ ধরা বন্ধ রাখি, তাহলে চলবো কীভাবে। সরকার তো আমাদের দুই/তিন মাস রিলিফ দিতে পারে। তাহলে আমরা বিলের মাছ রক্ষা করতে যেমন কাজ করবো, তেমনি আগের দিন ফিরে আসবে। মাছে ভরে যাবে চলনবিল।
বিল এলাকার শুটকি ব্যবসায়ী আব্দুল গফুর, সাচ্চু মিয়া ও আলমাস হোসেন বললেন, মৌসুমের শুরুতে অবাধে মাছ নিধন করায় বিলের পানি নেমে যাবার সময় মাছ পাওয়া যায় না। মাছের সংকটে শুটকির চাতাল বন্ধ রাখতে হয়। অথচ চলনবিলের শুটকির চাহিদা দেশজুড়ে। তাদের দেয়া তথ্যমতে চলনবিল এলাকায় অন্তত: দেড়শ’ চাতাল ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে।
পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া চলনবিলে রয়েছে মোট প্রায় ১৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৯৩টি বিল, ৪২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ৩২টি নদী ও ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট ২২টি খাল এবং অসংখ্য বড় বড় পুকুর জলাশয়। চলনবিল অঞ্চলের কয়েক হাজার পরিবার বিলের মাছের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে। চাটমোহর উপজেলাতে ৪ হাজার ২৭৬জন তালিকাভুক্ত জেলে রয়েছেন। মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করাই তাদের কাজ। দেশী মাছকে রক্ষা করতে এসকল জেলেদের রিলিফের আওতায় এনে তিন মাস চাউল প্রদান করার দাবি তাদের।
চলনবিলের সুস্বাদু মাছের চাহিদা রয়েছে দেশজুড়ে। কিন্তু প্রতি বছরই মাছের সংকটে এর উৎপাদন ক্রমশ আশঙ্কাজনক হারে কমছে। ফলে জেলেরা পেশা সংকটে পড়ছেন। অথচ এক সময় এখানে প্রচুর মাছ ধরা পরতো।
চলনবিলের খানমরিচ এলাকার আজগর আলী জানান, চলনবিল এলাকায় ‘সাবাড় বাহিনী’ চায়না দুয়ারি, কারেন্ট জাল ও বাদাই জাল দিয়ে পানি থেকে ছেঁকে তোলে মাছসহ অসংখ্য ক্ষুদে জলজপ্রাণি। যার কারণে মাছ সমুলে ধ্বংস হচ্ছে। প্রজননকালে মাছেরা যে সকল ক্ষুদে জলজপ্রাণি মাছের খাদ্য হিসাবে গ্রহন করে সেগুলো ধ্বংস হওয়ায় প্রজনন সংকটও তৈরি হচ্ছে। এসব কারণে চলনবিলে মাছের পরিমাণ দিন দিন কমছে।
চাটমোহর সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আব্দুল মতিন বলেন, চলনবিলে মাছ কম হওয়ার কারণ হচ্ছে- ক্ষণস্থায়ী বন্যা, চায়না দুয়ারি ওবাদাই জাল দিয়ে সেচে বেপরোয়া মাছ শিকার, বিলের কৃষি জমিতে রাসায়নিক কীটনাশক ও ঘাসমারা বিষ প্রয়োগ। চলনবিলের দেশী মাছের কদর সর্বত্র। এ অঞ্চলে মাছ সংরক্ষণে ব্যবস্থা নিলে বিলে মাছের প্রসার হবে। আমরা চলনবিলের মাছ রক্ষায় যে উদ্যোগ নিয়েছি। বিলপাড়ের সকল উপজেলাতেই এমন অভিযান চালাতে হবে। সৃষ্টি করতে হবে গণসচেতনতা।
চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুসা নাসের চৌধুরী বলেন, চলনবিলের সুস্বাদু দেশী মাছ রক্ষায় আমরা মাঠে নেমেছি। আমাদের এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
মন্তব্য (০)