মানিকগঞ্জ প্রতিনিধিঃ দিগন্ত মাঠ জুড়ে হলদে সরিষা ফুলের নয়ন প্রসন্ন করা যে রূপ দেখিয়াছি, মুহুমুহু মাতাল করা সেই গন্ধের মিঠালী সমীরণে, পলেপলে আমি যেন তার প্রেমে পড়িয়াছি। কবির ভাষার সরিষা ফুলের নয়ন প্রসন্ন করা মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখা পাবেন এখন মানিকগঞ্জের ফসলের মাঠে।
দূর থেকে দেখলে মনে হয় পুরো মাঠ যেন ছেয়ে আছে হলুদের চাদরে। সকালের মিষ্টি সোনা রোদে আরও চকচক করছে সর্ষে হলুদের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। মানিকগঞ্জ জেলার গ্রামীণ জনপদের ফসলের মাঠগুলো প্রকৃতির অপরূপ রূপে সেজেছে। এখানে এখন পথে ঘাটে মাঠে সরিষা ফুলের মৌ মৌ গন্ধ, আর বিস্তীর্ণ মাঠ জুড়ে শুধুই হলুদ রঙের সমারোহ।
জানা গেছে, জেলায় আমন ধান কাটার পরে বোরো ধানের চারা রোপনের মধ্যবর্তী সময়টাকে কাজে লাগাতে কৃষকেরা আবাদ করেন লাভজনক দানাদার শষ্য সরিষা। মধ্যবর্তী সময়ে আবাদ করা যায় বলে অনেক কৃষকই সরিষা চাষে উৎসাহী হয়। ১০০-১২০দিনে এ ফসলে ঘরে তোলা যায়।
কৃষকদের দাবি, উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে সরিষা চাষে বেশ মুনাফা হয়। আর সরিষার ফুল ও পাতা ঝড়ে পড়ায় জমি বেশ উর্বর হয়। সরিষা কাটার পর ওই জমিতে বোরো ধান আবাদ করলে সারের পরিমান কম লাগে। ফলে উৎপাদন খরচ কমে যায় ও ফলন হয় ভালো।
মানিকগঞ্জে ফসলের মাঠজুড়ে হিমেল বাতাসে দোল খাচ্ছে হলুদ রঙের সরিষা ফুল। আর এই ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করতে খেতের এক পাশে বসানো হয়েছে মৌবাক্স। সরিষা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে সেই মৌবাক্সে চলে যাচ্ছে মৌমাছিরা।
শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) সকালে মানিকগঞ্জের বিভিন্ন সরিষা ফুলের মাঠে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। সরিষা ফুল থেকে মৌমাছির মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করায় যেমন আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন মধু সংগ্রহকারীরা, তেমনি বাড়ছে সরিষার উৎপাদনও।
সরজমিনে দেখা যায়, মৌবাক্স থেকে মৌমাছিরা উড়ে গিয়ে পাশের সরিষা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে আবার মৌবাক্সের ভেতরে চলে যাচ্ছে। বাক্সের ভিতরে মৌচাকে মধু সংগ্রহ করছে মৌমাছিরা। ৩ থেকে ৪ দিন পরপর আগুনের ধোঁয়া দিয়ে এসব বাক্স থেকে মৌমাছি সরিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিটি বাক্সের ভেতরে ছয়টি থেকে আটটি ফ্রেমে মৌচাক থাকে। এসব মৌচাক একটি স্টিলের ড্রামের ভেতরে নিয়ে ঘূর্ণায়মান যন্ত্রের মাধ্যমে মধু বের করা হয়। পরে এসব মধু সংগ্রহ করে প্লাস্টিকের ড্রামভর্তি করা হয় এবং তা বাজারজাত করা হয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মানিকগঞ্জের সাতটি উপজেলাতেই সরিষার আবাদ হয়। এ বছর জেলায় ৭১ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। জেলার সাতটি উপজেলায় এ বছর ১২০ জন মৌচাষি প্রায় ১২ হাজার মৌবাক্স বসিয়েছেন। এসব মৌবাক্স থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার কেজি মধু সংগ্রহ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা প্রতি কেজি মধু ২৫০ টাকা দরে বিক্রি হলে, তার মূল্য দাঁড়ায় ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
বাগেরহাটের সদর উপজেলার ভুয়াদুখালী গ্রামের মৌচাষি (মধুসংগ্রাহক) মো. ফয়সাল হোসেন মানিকগঞ্জের সদর উপজেলার দিঘী গ্রামে ২১ দিন আগে হলুদ সরিষা ফুলের মাঠের এক পাশে ৯০টি মৌবাক্স বসিয়েছেন মধু সংগ্রহের জন্য। ইতিমধ্যেই তিনি মৌমাছির মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করে তা বাজারজাত করেছেন এবং ভালো মূল্যও পেয়েছেন বলে জানান।
রাছেল হোসেন নামের আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ২০০৮ সাল থেকে তিনি মানিকগঞ্জে মৌচাষ ও মধু সংগ্রহ করে আসছেন। গত বছর চার মাসে প্রায় ৬০ মণ মধু সংগ্রহ করেছেন। প্রতি কেজি মধু ৩০০ টাকা দরে বিক্রি করেন। এসব মধু তিনি ডাবর, এপি ও এসিআই কোম্পানির কাছে বিক্রি করেন।
জেলা সদরের কয়ড়া গ্রামের শর্ষে খেতের পাশে শতাধিক মৌবাক্স বসিয়ে মধু সংগ্রহ করছেন মৌচাষি মহিদ মল্লিক। তিনি বলেন, প্রতি সপ্তাহে প্রতিটি মৌবাক্স থেকে দেড় থেকে দুই কেজি করে মধু পাওয়া যায়। এসব মধুর স্বাদ ও গুণগত মান অনেক ভালো।
জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক ড. রবীআহ নূর আহমেদ বলেন, মৌচাষের কারণে পরাগায়ণ বেড়ে যাওয়ায় ফসলের উৎপাদন ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। ফসলের গুণগত মানও ভালো হয়। পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ মধু পাওয়া যায়। এসব মধু বাজারজাত সহজকরণ ও ন্যায্যমূল্য পেতে মৌচাষিদের সঙ্গে পাইকার ব্যবসায়ী বা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগসূত্র তৈরির জন্য কাজ করে যাচ্ছি আমরা।
মন্তব্য (০)