• বিশেষ প্রতিবেদন

বৃদ্ধ বয়সে অন্যের জমি চাষাবাদ করে দুর্বিষহ দিন কাটছে মুক্তিযোদ্ধার

  • বিশেষ প্রতিবেদন
  • ২২ ডিসেম্বর, ২০২১ ১২:৩৪:০২

ছবিঃ সিএনআই

প্রতিনিধি, পাবনাঃ  দেশ মাতৃকার টানে কাউকে না বলে বাড়ি ছেড়েছিলেন আমির হামজা। কখনও মারামারি করেননি, অথচ দেশের মুক্তির জন্য হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র। যুদ্ধের সময় খেয়ে না খেয়ে কেটেছে কত দিন-রাত তার হিসেব নেই। তবে মনে ছিল দৃঢ় প্রতিজ্ঞা আর অন্তরে ছিল দেশপ্রেম। তাই স্বাধীন দেশে ফিরেছিলেন বিজয়ের বেশে।

অথচ দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা পেয়ে আসা আমির হামজার ভাতা গত সাড়ে ৬ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে দৌঁড়াদৌঁড়ি করেও ভাতা চালু হচ্ছে না তার। আর ভাতা বন্ধ হওয়ার পর থেকে পরিবার নিয়ে দূর্বিষহ জীবন যাপন করছেন তিনি। স্ত্রী অসুস্থ, ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে পারছেন না। বিবাহযোগ্যা দুটি মেয়েকে বিয়ে দিতে পারছেন না। ভাঙাচোরা ঘরে কোনোমতো বসবাস করছেন। বৃদ্ধ বয়সে অন্যের জমি চাষাবাদ করতে হচ্ছে তাকে।

পাবনার চাটমোহর উপজেলার ছাইকোলা ইউনিয়নের কাটেঙ্গা হিন্দুপাড়া গ্রামের মৃত জামাল উদ্দিন ও মৃত রহিতন নেছা দম্পতির ছেলে বীরমুক্তিযোদ্ধা আমির হামজার জন্ম ১৯৫০ সালের ১৫ মে। তার বর্তমান বয়স ৭১ বছর।

আলাপকালে মুক্তিযোদ্ধা আমির হামজা বলেন, একাত্তরের ৭ই মার্চ রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বের হন তিনি। সাথে ছিলেন একইগ্রামের নজরুল ইসলাম। তাড়াশে গিয়ে বিভিন্ন পরিত্যক্ত বাড়িতে অবস্থান নেন। তখনকার কমান্ডার কাছিম উদ্দিন ওরফে কইছ্যা দেওয়ানের নেতৃত্বে ৫ জন মুক্তিযোদ্ধা তাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেন। সেখান থেকে পাশের গ্রামের যাবার পথে দু’জন রাজাকারকে হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধারা। আর মিলিটারীরা অস্ত্র ফেলে পালিয়ে গেলে সেই অস্ত্র দেয়া হয় প্রশিক্ষণ নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের। পরে সবচেয়ে বড় সম্মুখযুদ্ধ নওগাঁ যুদ্ধে অংশ নেন আমির হামজা। এছাড়া আশপাশের কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নেন তিনি। তার আগে ব্যটালিয়ন কমান্ডার লুৎফর রহমান অরুন তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।

স্মৃতি হাতড়ে আমির হামজা বলেন, ১১ নভেম্বর আঞ্চলিক বাহিনীর নেতা লতিফ মির্জার নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। সেদিন ছিল রোববার। রোযার দিন। অনেকে সেহরী খেয়েছে, অনেকে খায়নি। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। একজন এসে জানায়, তাদের বাড়িতে কারা যেন এসেছে। এর কিছু সময় পরই পাকবাহিনী গুলি করতে করতে এগিয়ে আসে। মুক্তিযোদ্ধারাও গুলিবর্ষণ শুরু করে। ভোর থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত চলে যুদ্ধ। ৮০ থেকে ৯০ জন মিলিটারী মারা যায় আর ৯ জনকে জীবিত ধরে তাদের শীতলাই পুকুরপাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।

মুক্তিযোদ্ধা আমির হামজা বলেন, ওই সময় যুদ্ধ করতে করতে গুলি শেষ হয়ে যায়। তখন একদল মুক্তিযোদ্ধা ভারতে যান গুলি আনতে। আর একদল মুক্তিযোদ্ধা এলাকার যুবকদের একত্রিত করে ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠায়। নভেম্বরের মাঝামাঝি তিনি আবারও ভারতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সাহেববাজারে প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণে থাকাবস্থায় দেশ স্বাধীন হয়। তখন অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার সাথে দেশে ফেরেন আমির হামজা।

দেশে ফিরে ১৯৭৪ সালে বিয়ে করেন মুক্তিযোদ্ধা আমির হামজা। সংসার জীবনে ৫ মেয়ে আর ১ ছেলের জনক তিনি। ৩ মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। এখনও দুই মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। ২০০৬ সালের জুলাই মাস থেকে ভাতা পাওয়া শুরু করেন আমির হামজা। সোনালী ব্যাংক থেকে ভাতা তুলতেন তিনি। তার অ্যাকাউন্ট নাম্বার ০২২০৫০২০২, বই নং ৬৮। ২০১৫ সালের জুলাই মাসের ভাতা তোলার পর থেকে আর কোনো ভাতা পাচ্ছেন না বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির হামজা। এরপর গত সাড়ে ৬ বছল ধরে ভাতা বন্ধ হয়ে আছে তার।

ভাতা বন্ধের বিষয়ে আমির হামজা বলেন, মুক্তিবার্তায় নাম ঠিকানা সব আছে। কিন্তু সেখানে নাম্বার ছিল না। উল্লেখ রয়েছে দাবিদার। উপজেলায় যোগাযোগ করলে তাকে আবেদন নিয়ে মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করতে বলা হয়। বৃদ্ধ বয়সে কয়েকবার তিনি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়, গণভবনে দৌঁড়ঝাপ করেছেন। কিন্তু কাজ হয়নি এখনও। সর্বশেষ গত ২৬ সেপ্টেম্বর জামুকার ৭৬ তম সভার আলোচ্যসূচীর ০৭ এর সিদ্ধান্ত অনুসারে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তির যাচাই বাছাই হয়। সেখানে তার পক্ষের সকল কাগজপত্র জমা দেয়া হয়েছে। সেখান থেকে আমির হামজাকে আশ^স্ত করা হয়েছে এবার তালিকাভুক্ত হবেন তিনি। পলাশডাঙ্গা যুদ্ধ শিবিরের ফলকে তার নাম রয়েছে, যুদ্ধ শেষে অস্ত্র জমা দিয়েছেন, আছে মুক্তিযোদ্ধার বিভিন্ন সনদপত্র। গেজেটে নাম অন্তর্ভূক্তির জন্য এর আগে আবেদন করেছিলেন। তৎকালীন ইউএনও শফিকুল ইসলাম তাকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে উল্লেখ করে প্রতিবেদনও দিয়েছেন। এতকিছুর পরও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত কেন করা হচ্ছে না, প্রশ্ন আমির হামজার।

জানা গেছে, ভাতা বন্ধ হওয়ার কারণে একমাত্র ছেলে আওরঙ্গজেব সেলিমের কলেজের বেতন দিতে পারেননি তিনি। ৫ বছর আগে সেই যে ছেলে রাগ করে বাড়ি ছেড়েছে, আজও তার কোনো খবর পাননি। ঢাকার ইডেন মহিলা কলেজ থেকে সমাজ বিজ্ঞান থেকে মাস্টার্স পাশ করে বাড়িতে বসে আছেন মেয়ে মেরিনা খাতুন। আরেক মেয়ে শিরীনা খাতুন চাটমোহর সরকারি অনার্স কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে পড়ছেন।

আমির হামজা আক্ষেপ করে বলেন, দুটি টিনের ঘর থাকলেও ভাঙাচোরা বসবাস অযোগ্য। দুটি বিবাহযোগ্যা মেয়ে, অথচ অর্থাভাবে তাদের বিয়েশাদি দিতে পারছি না। ঘরে স্ত্রী সেলিনা খাতুন অসুস্থ্য। তারও চিকিৎসা করাতে পারছি না। এতদিন ভাতা পেয়ে হঠাৎ ভাতা বন্ধ হওয়ায় খুব ভেঙে পড়েছেন। বৃদ্ধ বয়সে চারজনের সংসার চালাতে বাধ্য হয়ে অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করছি। শেষ বয়সে সরকারের কাছে আমির হামজার দাবি, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তার নাম তালিকাভুক্ত করে ভাতাটা চালু করা হোক। তাহলে পরিবার নিয়ে শান্তিতে কাটাতে পারতাম।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেন উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার এস এম মোজাহারুল হক বলেন, আমি নিজে চেষ্টা করে একসময় আমির হামজাকে মুক্তিযোদ্ধা সম্মানীর ভাতা পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। পরবর্তীতে তালিকা তার নাম বাদ পড়ে। তালিকায় নাম ওঠানোর জন্য তাকে ঢাকায় মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করতে বলেছিলাম। এখন তালিকায় তার নাম নেই। আগামীতে যাচাই-বাছাই হলে বিষয়টির ব্যাপারে সহযোগিতা করা হবে।

চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সৈকত ইসলাম বলেন, ওই মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বন্ধের বিষয়টি সম্পর্কে আমার কিছু জানা ছিলনা, সম্প্রতি জানতে পেরেছি। উপজেলার সাবেক কমান্ডারের সাথে কথা বলে এবং কাগজপত্র দেখে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় কি ব্যবস্থা নেয়া যায় দেখবো।

মন্তব্য ( ০)





  • company_logo