• আন্তর্জাতিক

যুদ্ধে রুশ বিলিয়নেয়ারদের যেভাবে হাতের মুঠোয় রেখেছেন পুতিন

  • আন্তর্জাতিক

ছবিঃ সংগৃহীত

নিউজ ডেস্ক : ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালেই রাশিয়ায় বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা পৌঁছেছে রেকর্ড উচ্চতায়; কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে যতই ফুলে-ফেঁপে উঠুক না কেন, রাজনৈতিক বাস্তবতায় তারা এখন কার্যত কোণঠাসা। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ‘পুরস্কার ও তিরস্কার’ নীতির পাশাপাশি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার চাপ— সব মিলিয়ে রাশিয়ার এই অতিধনীরা এখন ক্রেমলিনের অনুগত ও নীরব সমর্থকে পরিণত হয়েছেন। তাদের হাত ধরেই সচল রাখা হচ্ছে রাশিয়ার যুদ্ধ অর্থনীতি।

ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধের মধ্যেই রাশিয়ায় শতকোটিপতি বা বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে পুতিনের ২৫ বছরের শাসনামলে দেশটির ধনী ও প্রভাবশালী শ্রেণির রাজনৈতিক প্রভাব প্রায় পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়েছে।

পুতিনের দৃষ্টিতে এটি নিঃসন্দেহে সুখবর। পশ্চিমা দেশগুলো যেসব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, সেগুলো রুশ ধনীদের পুতিনের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে ব্যর্থ হয়েছে। বরং ‘গাজর ও লাঠি’ নীতির মাধ্যমে পুতিন তাদের নিজের নীরব সমর্থকে পরিণত করেছেন।

এই ‘তিরস্কার’ কিভাবে নেমে আসে, তা ভালোভাবেই জানেন সাবেক ব্যাংকিং বিলিয়নেয়ার ওলেগ টিঙ্কভ।

ইনস্টাগ্রামে এক পোস্টে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধকে ‘পাগলাটে’ বলে সমালোচনা করেছিলেন টিঙ্কভ। ঠিক পরদিনই ক্রেমলিন থেকে তার প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়— প্রতিষ্ঠাতার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন না করলে ব্যাংকটি জাতীয়করণ করা হবে। তখন সেটি ছিল রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাংক।

টিঙ্কভ পরে বলেন, ‘দাম নিয়ে কোনো আলোচনার সুযোগই ছিল না। পরিস্থিতি ছিল একপ্রকার জিম্মি দশার মতো— আপনাকে যা দেওয়া হবে, সেটাই নিতে হবে। দরকষাকষির কোনো অবকাশ ছিল না।’

এক সপ্তাহের মধ্যেই ভ্লাদিমির পোটানিনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি কোম্পানি ব্যাংকটি কেনার ঘোষণা দেয়। পোটানিন বর্তমানে রাশিয়ার পঞ্চম শীর্ষ ধনী এবং তিনি যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন তৈরিতে ব্যবহৃত নিকেল সরবরাহ করেন। টিঙ্কভের দাবি, ব্যাংকটির প্রকৃত বাজারমূল্যের মাত্র ৩ শতাংশ দামে সেটি বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়েছিল।

সব মিলিয়ে টিঙ্কভ হারান প্রায় ৯০০ কোটি ডলারের সম্পদ। শেষ পর্যন্ত দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমান তিনি। তবে পুতিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগের রাশিয়া ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক বাস্তবতা।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিশাল শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর দখল নেন কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি। সদ্য বিকাশমান পুঁজিবাদের সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা অল্প সময়েই বিপুল সম্পদের মালিক হন।

রাজনৈতিক অস্থিরতার সেই সময় বিপুল সম্পদ তাদের এনে দেয় অসীম প্রভাব ও ক্ষমতা। এই শ্রেণিই পরিচিতি পায় ‘অলিগার্ক’ নামে।

রাশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী অলিগার্কদের একজন বরিস বেরেজোভস্কি দাবি করেছিলেন, ২০০০ সালে পুতিনকে ক্ষমতায় আনতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। কয়েক বছর পর তিনি প্রকাশ্যে এর জন্য ক্ষমাও চান।

২০১২ সালে লেখা এক নিবন্ধে বেরেজোভস্কি বলেন, ‘তখন আমি তার মধ্যে ভবিষ্যতের সেই লোভী স্বৈরাচার ও দখলদারকে দেখতে পাইনি, যে একদিন স্বাধীনতাকে ধ্বংস করবে এবং রাশিয়ার অগ্রগতি থামিয়ে দেবে।’

বেরেজোভস্কি হয়তো নিজের ভূমিকা কিছুটা বাড়িয়েই বলেছিলেন। তবে সেই সময় অলিগার্কদের যে রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষ পর্যায়ে প্রভাব ছিল, তা নিয়ে সন্দেহ নেই।

ক্ষমা চাওয়ার এক বছরের কিছু বেশি সময় পর যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত অবস্থায় রহস্যজনকভাবে বেরেজোভস্কির মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তত দিনে রাশিয়ার অলিগার্কতন্ত্র কার্যত ইতিহাসে পরিণত হয়েছে।

এ কারণেই ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন শুরুর কয়েক ঘণ্টা পর ক্রেমলিনে যখন পুতিন শীর্ষ ধনীদের ডেকে পাঠান, তখন তাদের কিছু বলার বা করার ছিল না। তারা জানতেন— সম্পদের বড় ধাক্কা আসছে। তবু প্রতিবাদের সাহস কারও ছিল না।

পুতিন তখন বলেন, ‘আমি আশা করি, এই নতুন বাস্তবতায়ও আমরা আগের মতো একসঙ্গে এবং সমান কার্যকরভাবে কাজ করব।’

বৈঠকে উপস্থিত এক সাংবাদিকের ভাষায়, সেখানে জড়ো হওয়া বিলিয়নেয়ারদের মুখ ছিল ফ্যাকাশে, চোখেমুখে স্পষ্ট ছিল নির্ঘুম রাতের ছাপ।

যুদ্ধের আগের সময়টাও রাশিয়ার বিলিয়নেয়ারদের জন্য খুব ভালো ছিল না। যুদ্ধ শুরুর পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।

ফোর্বসের তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা ও রুবলের দরপতনের ফলে ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এক বছরে রাশিয়ায় বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা ১১৭ থেকে নেমে আসে ৮৩-তে। সম্মিলিতভাবে তারা হারান ২৬ হাজার ৩০০ কোটি ডলার। গড়ে প্রত্যেকের সম্পদ কমে যায় ২৭ শতাংশ।

কিন্তু পরবর্তী বছরগুলোতে দৃশ্যপট বদলে যায়। পুতিনের ‘যুদ্ধ অর্থনীতির’ অংশ হয়ে অনেকেই আবার বিপুল লাভবান হন।

যুদ্ধের খাতে ব্যাপক ব্যয়ের ফলে ২০২৩ ও ২০২৪ সালে রাশিয়ার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের বেশি ছিল। শুধু প্রতিরক্ষা খাত নয়, এর সুফল পেয়েছেন অন্যান্য খাতের ধনীরাও।

ফোর্বসের সম্পদবিষয়ক বিশ্লেষক জিয়াকোমো তগনিনি বলেন, ২০২৪ সালে রাশিয়ার অর্ধেকের বেশি বিলিয়নেয়ার হয় সরাসরি সেনাবাহিনীকে রসদ জুগিয়েছেন, নয়তো যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে কোনো না কোনোভাবে লাভবান হয়েছেন।

তার ভাষায়, ‘যারা সরাসরি জড়িত নন, কিন্তু ক্রেমলিনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হয়— তাদের হিসাবেও ধরা হয়নি। রাশিয়ায় ব্যবসা করতে হলে সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকাই বাস্তবতা।’

চলতি বছর ফোর্বসের তালিকায় রাশিয়ায় রেকর্ড ১৪০ জন বিলিয়নেয়ারের নাম উঠেছে। তাদের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ ৫৮ হাজার কোটি ডলার; যা যুদ্ধের আগের সর্বোচ্চ সময়ের তুলনায় মাত্র ৩০০ কোটি ডলার কম।

অনুগতদের জন্য মুনাফার পথ খোলা থাকলেও যারা নির্দেশ অমান্য করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে পুতিন বরাবরই কঠোর হয়েছেন।

তেল ব্যবসায়ী মিখাইল খোদরকভস্কির পরিণতি আজও রুশ সমাজে সতর্কবার্তা হিসেবে আলোচিত। একসময় রাশিয়ার শীর্ষ ধনী এই ব্যক্তি ২০০১ সালে গণতন্ত্রপন্থি সংগঠন গঠনের পর ১০ বছর কারাভোগ করেন।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়ার প্রায় সব অতিধনী প্রকাশ্যে নীরবতা পালন করছেন। যে কজন যুদ্ধবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন, তাদের দেশ ও সম্পদের বড় অংশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে।

পুতিনের যুদ্ধযন্ত্র সচল রাখতে রাশিয়ার ধনীরা যে বড় ভূমিকা রাখছেন, তা স্পষ্ট। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ক্রেমলিনে তলব করা ৩৭ জন ব্যবসায়ীসহ বহু ধনীর ওপরই পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।

পশ্চিমাদের উদ্দেশ্য যদি ধনীদের নিঃস্ব করে পুতিনবিরোধী করতে হয়, তবে তা ব্যর্থ হয়েছে। কারণ সম্পদ যেমন বেড়েছে তেমনি ভিন্নমতের কোনো চিহ্নও দেখা যায়নি। নিষেধাজ্ঞার কারণে বিপুল সম্পদ নিয়ে পশ্চিমে পাড়ি দেওয়ার পথও কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।

সেন্টার ফর ইউরোপিয়ান পলিসি অ্যানালাইসিসের আলেকজান্ডার কোলিয়ান্দ্রি বলেন, ‘পশ্চিমাদের পদক্ষেপ রাশিয়ার বিলিয়নেয়ারদের জাতীয় পতাকার নিচে—অর্থাৎ পুতিনের পক্ষে— একজোট হতে বাধ্য করেছে।’

তার মতে, ‘সম্পদ জব্দ ও অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার ফলে তাদের পক্ষ বদলের কোনো বাস্তব পথ খোলা ছিল না। বরং পুতিন এই সম্পদগুলো যুদ্ধ অর্থনীতিতে কাজে লাগাতে পেরেছেন।’

ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বিদেশি কোম্পানিগুলো রাশিয়া ছাড়লে যে শূন্যতা তৈরি হয়, তা দ্রুত পূরণ করেন ক্রেমলিন– ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা। নামমাত্র দামে তারা অত্যন্ত লাভজনক সম্পদ কিনে নেওয়ার সুযোগ পান।

কার্নেগি রাশিয়া ইউরেশিয়া সেন্টারের আলেকজান্দ্রা প্রোকোপেনকোর মতে, এর ফলে ‘একটি নতুন অনুগত ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ী শ্রেণি’ তৈরি হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘রাশিয়া ও পশ্চিমাদের মধ্যে সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হওয়াতেই তাদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ। সবচেয়ে বড় আশঙ্কা— আগের মালিকদের প্রত্যাবর্তন।’

জিয়াকোমো তগনিনির তথ্যমতে, শুধু ২০২৪ সালেই এভাবে ১১ জন নতুন বিলিয়নেয়ারের আবির্ভাব হয়েছে।

সব মিলিয়ে যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও রাশিয়ার প্রভাবশালী শ্রেণির ওপর নিজের কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছেন পুতিন। বরং অনেক ক্ষেত্রে এই সংঘাতই তার ক্ষমতার ভিত্তিকে আরও মজবুত করেছে।

 

মন্তব্য (০)





image

ইউক্রেন শান্তি না চাইলে বল প্রয়োগে রাশিয়া লক্ষ্য অর্জন কর...

নিউজ ডেস্ক : রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, শান্তির জন্য ইউ...

image

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ২২ গুণ বেড়েছে রাশিয়ার অস্ত্র: পুতিন

নিউজ ডেস্ক : ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়া তার অস্ত্র ও গোলাবারুদ উ...

image

৩০ বছর পর শিশু জন্ম নিল যে গ্রামে

নিউজ ডেস্ক : ইতালির আবরুজো অঞ্চলের মাউন্ট গিরিফালকোর ঢালে অবস্থিত প্রাচী...

image

‎মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাকের ১৫ বছরের ...

নিউজ ডেস্কঃ ক্ষমতার অপব্যবহার, অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের মামলায়...

image

বৈশ্বিক ব্র্যান্ড সূচকে টানা দ্বিতীয়বার সর্বনিম্নে ইসরাইল

নিউজ ডেস্ক : বিশ্বব্যাপী দেশের ভাবমূর্তি মূল্যায়নের সূচক নেশন ব্র্যান্ডস...

  • company_logo