নিউজ ডেস্কঃ অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজামান বলেছেন, দায়িত্বপালনকালীন সময়ে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক সততার এক সুদক্ষ কারিগর। আজ বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) আপিল বিভাগের এজলাস কক্ষে প্রধান বিচারপতির বিদায়ি সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল প্রধান বিচারপতিকে সংবর্ধনা দিতে গিয়ে বলেন, আপনি উত্তরাধিকার সূত্রে এমন এক বিচারব্যবস্থা পেয়েছিলেন যেখানে প্রায়ই আইনের শাসনের পরিবর্তে সুবিধার শাসন জেঁকে বসেছিল। গত ১৬ মাসে আপনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক সততার এক সুদক্ষ কারিগর। এই অল্প সময়ে আপনি বহু যুগান্তকারী বা ট্রান্সফরমেটিভ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, যার সবগুলো উল্লেখ করার মতো সময় বা সুযোগ এখানে নেই। তবে আপনার গৃহীত ও বাস্তবায়িত উদ্যোগগুলোর মধ্যে না বললেই নয়, এরকম কয়েকটি হলো:
ক) পৃথক বিচারিক সচিবালয় (সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয়) : দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে মাসদার হোসেন মামলার রায় ছিল এক চমৎকার কিন্তু উপেক্ষিত ব্লু-প্রিন্ট। আপনার সাহসেই একটি স্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় আজ এক দৃশ্যমান বাস্তবতা।
খ) মেধাভিত্তিক ও স্বচ্ছ নিয়োগ ব্যবস্থা : আপনি রাজনৈতিক অনুকম্পায় নিয়োগের সংস্কৃতি ভেঙে দিয়েছেন। আপনার উদ্যোগে প্রণীত সুপ্রিম কোর্ট বিচারক নিয়োগ অধ্যাদেশ, ২০২৫ এবং সুপ্রিম জুডিসিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল আমাদের বিচারিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী সংযোজন।
গ) মনোবল বৃদ্ধি ও জবাবদিহি : এই বছর ২৩২টি নতুন বিচারিক পদ সৃষ্টি এবং ৮২৬ জন কর্মকর্তার পদোন্নতি ছিল এক বিশাল মাইলফলক। এছাড়া বিচারকদের জন্য সুদমুক্ত ঋণ এবং গাড়ি নগদায়ন সুবিধা প্রদানের নির্দেশ কর্মকর্তাদের মনোবল তুঙ্গে নিয়ে গেছে।
ঘ) ডিজিটালাইজেশন : হাইকোর্টের কোম্পানি বেঞ্চে কাগজমুক্ত বিচার কার্যক্রম এবং হেল্পলাইন চালুর মাধ্যমে আপনি সাধারণ মানুষের ভোগান্তি লাঘব করেছেন।
৬) কমার্শিয়াল কোর্ট প্রতিষ্ঠা : একুশ শতকের উপযোগী কার্যকর ও গতিশীল বিচার কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে আপনার নীতি-পরিকল্পনা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কমার্শিয়াল বা বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠার জন্য আইন প্রণীত হয়েছে। বাংলাদেশ অচিরেই এই উদ্যোগের সুফল ভোগ করবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, আপনি আপনার চিন্তা, দৃঢ় দৃষ্টিভঙ্গি এবং অনমনীয় সততার মাধ্যমে বাংলাদেশের বিচার জগতে একজন প্রমিথিউস হয়ে উঠেছেন। যতবার এই বিচার বিভাগ তার পথ হারানোর চেষ্টা করেছে, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে, অহেতুক বাজে আক্রমণের শিকার হয়েছে, স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থের কেন্দ্রে পরিণত হয়ে বিচার বিভাগ ধ্বংসের উপক্রম হয়েছে, ততবার এই বিচার বিভাগ ফিনিক্স পাখির মতো আপনার হাত ধরে তার সঠিক গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলেছে। আপনার প্রজ্ঞা এবং পাণ্ডিত্যের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া পর্যন্ত এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে থাইল্যান্ড থেকে দুবাইয়ের গ্লোবাল গভর্নমেন্ট সামিট, মিশর থেকে ব্রাজিল-প্রতিটি আন্তর্জাতিক মঞ্চে আপনার উপস্থিতি আমাদের গর্বিত করেছে। বিশেষ করে, পরিবেশগত ন্যায়বিচার বা ইনভাইরনমেন্টাল জাস্টিস নিয়ে আপনার অবদান আজ বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অনারারি ফেলোশিপ অর্জন আমাদের সমগ্র বিচার বিভাগের জন্য এক অনন্য সম্মান। আজ বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে আমি এখানে কেবল রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা হিসেবে দাঁড়াইনি, বরং ইতিহাসের একজন ছাত্র হিসেবেও দাঁড়িয়েছি। আমার জীবনের আইন পেশার অনন্য এবং অনবদ্য একটি অংশ অতিবাহিত হয়েছে আপনার মরহুম পিতা ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের জুনিয়র হিসেবে এবং সেখানে আপনার সহকর্মী হিসেবে। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি আমার গুরু ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদের চেম্বারে সংবিধান কেবল কোনো পাঠ্যবই ছিল না; সেটি ছিল এক জীবন্ত ও স্পন্দিত বিবেক।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আজ যখন এই এজলাসে আপনার দিকে তাকাই, আমি ঠিক সেই একই আপসহীন ও নৈতিক ব্যক্তিত্বের ছায়া দেখতে পাই। আপনি আপনার পিতামহ এবং পিতার সেই অসম্পূর্ণ বিপ্লবকে সফল করেছেন। আপনার মা, প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদের সেই প্রজ্ঞা এবং ভাষা আন্দোলনের তেজ আপনার নেতৃত্বের প্রতিটি পরতে মিশে আছে। আপনি প্রমাণ করেছেন যে, উত্তরাধিকার কেবল নামের ভার নয়, বরং কর্মের মাধ্যমে তাকে আরও উজ্জ্বল করার নাম। আপনি আমাদের সতর্ক করেছেন প্রতিষ্ঠান তৈরি করা সহজ, কিন্তু তার আত্মাকে রক্ষা করা কঠিন।
আপনি বলেছেন, আমরা যদি আমলনামায় স্বচ্ছ না থাকি, তবে কোনো সচিবালয় আমাদের রক্ষা করতে পারবে না। আপনার এই সতর্কবাণী আমাদের হৃদয়ে গেঁথে থাকবে।
বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে স্বল্প সময়ের এই টেনিউরে আপনি আপনার প্রজ্ঞা, মেধা ও দূরদর্শিতার দ্বারা স্থাপন করেছেন এক অনন্য বিচার বিভাগীয় মানদণ্ড যাকে আমি নাম দিয়েছি দ্য রেফাত স্ট্যান্ডার্ড, যা বিচারিক সাহসিকতা এবং পরম স্বচ্ছতার এক মূর্ত প্রতীক। আমরা অবগত হয়েছি যে, শিগগিরই আপনি ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে পবিত্র ভূমিতে যাত্রা করবেন এবং আগামী ২৭ ডিসেম্বর তারিখে আপনার স্বাভাবিক কর্মকালের অবসান হবে। কিন্তু নিশ্চিত থাকুন এই বিদায় কালে আপনি সঙ্গে নিয়ে যাবেন বাংলাদেশের আপামর মানুষের নিভৃত প্রার্থনা; রাশি রাশি ফুলের শুভেচ্ছা আর এক সমুদ্র সম্মান-ভালোবাসা।
আবেগ আপ্লুত হয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, প্রধান বিচারপতি, আপনি আমাদের শিখিয়েছেন, "Let justice be done, though the heavens fall"। এই ঐতিহ্যবাহী সুপ্রিম কোর্ট বার এবং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আমি আপনাকে জানাই অশেষ কৃতজ্ঞতা। আপনি আমাদের কাছে এসেছিলেন এক উত্তপ্ত বিপ্লবের ঋতুতে; আর বিদায় নিচ্ছেন বিজয়, শান্তি এবং স্বচ্ছতার এক অনন্য ঋতুতে। আপনার প্রতি অন্তর নিংড়ানো অভিবাদন! আমরা সবাই প্রার্থনা করছি সর্বশক্তিমান আল্লাহ আপনাকে সুনির্মল স্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু দান করুন। আপনি যে স্বাধীন সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় এবং বিচার বিভাগীয় সংস্কারের বীজ বুনে দিয়ে যাচ্ছেন, আমরা আশা করছি, তাকে আমরা মহীরুহে পরিণত করব, ইনশাআল্লাহ। সবশেষে, আমরা গভীরভাবে অনুধাবন করি যে, আমরা আপনাকে ভালোবেসেছিলাম, শ্রদ্ধায়, বিনয়ে, বিপ্লবে ও বিদ্রোহে। বিচার বিভাগীয় সংস্কারের ক্ষেত্রে আপনি আমাদের কাছে চে গুয়েভারার মতোই এক বিপ্লবী চেতনার মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। আপনাকে একবার ভালোবাসতে শুরু করলে আপনার প্রত্যেক অনুসারীর কাছে সেই ভালোবাসা অবিনশ্বর হয়ে দাঁড়ায়।
এই প্রেক্ষাপটে তাই আজ আমাদের মহান জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম থেকে ধার করে বলতে চাই- ‘তোমারে যে চাহিয়াছে ভুলে একদিন, সে জানে তোমারে ভুলা কি কঠিন ‘
আমরা আপনাকে আজীবন মনে রাখবো, ভুলবো না, আপনি আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায় এভাবেই উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন। আমাদের প্রতিটি সংকটে, সংকল্পে, বিপ্লবে ও বিদ্রোহে একজন ভালোবাসার মানুষ হিসাবে, একজন অভিভাবক হয়ে আপনি সব সময় আমাদের সঙ্গে থাকবেন।
আগামী ২৭ ডিসেম্বর অবসরে যাচ্ছেন প্রধান ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। আজ ছিল তার শেষ কর্মদিবস।
মন্তব্য (০)