• বিশেষ প্রতিবেদন

মা‌নিকগঞ্জ জেলার প্রথম শহীদ মিনারটি এখন অব‌হেলায় দেয়ালবন্দি

  • বিশেষ প্রতিবেদন
  • ০৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২২ ১৬:১৮:৪৫

ছবিঃ সিএনআই

মা‌নিকগঞ্জ প্রতিনিধিঃ ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংগ্রামের স্বাক্ষী মানিকগঞ্জের প্রথম শহীদ মিনারটি এখন তিন দেয়ালে বন্দি। এক সময় যে শহীদ মিনার ঘিরে মানিকগঞ্জের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সক্রিয় ছিল সেখানে এখন আর কেউ ফুল দেয় না। অ‌নেকটা অব‌হেলা প‌রে ‌আছে মানিকগঞ্জের প্রথম শহীদ মিনারটি। বর্তমা‌নে এস‌কে সরকা‌রি বা‌লিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অপেক্ষাকালীন বসার স্থান হয়ে গেছে এই মিনারটি। তাদের বসার কারণে ভেঙে গেছে মিনারের রেলিং।

ভাষা আন্দোলনে ৬৮ বছর পার হলেও আজও অবহেলিত মানিকগঞ্জ জেলার প্রথম শহীদ মিনারটি। ভাষার আন্দোলনে প্রথম শহীদ রফিকের জেলা মানিকগঞ্জে শহীদদের স্মরণে ১৯৫৪ সালে নির্মিত হয়েছিল মানিকগঞ্জ অঞ্চলের প্রথম শহীদ মিনার।

প্রায় ৬৮ বছর আগে ১৯৫৪ সালে ভাষা শহীদদের স্বরণে মানিকগঞ্জে এই শহীদ মিনারটি স্থাপিত হয়েছিল। 

১৯৫২ সনে ২১ ফেব্রুয়ারির পর মানিকগঞ্জের ছাত্র জনতার উদ্যোগে জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মাণ করা হয় শহীদ মিনার। খবর পেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে শাসকের আজ্ঞাবহ প্রশাসন সেখানে উপস্থিত হয় এবং মিনারগুলো ভেঙে চুরমার করে দেয়, শাসিয়ে যায় এসবের উদ্যোক্তাদের। 

১৯৫৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ বায়ান্নর ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের ঠিক দুই বছর পরের কথা। ছাত্র জনতাও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, ২১ ফেব্রুয়ারি প্রভাতে তারা ভাষা শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনারে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করবেই। কিন্তু কোথায়? শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কে দেবে স্থান? কার সাহস আছে শাসকের হুমকি সামাল দেবে? এমন প্রশ্ন যখন তাদের মনে, তখন এগিয়ে এলেন এক নারী। শহিদ মিনার নির্মাণের জন্য এগিয়ে এলেন যুক্তফ্রণ্ট সরকারের সাবেক মন্ত্রী আব্দুল লতিফ বিশ্বাসের সহধর্মিনী উম্মে সাহেরা খাতুন। মানিকগঞ্জ শহরের এসকে বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিপরীত দিকে তার বাড়ি। তিনি অনুমতি দেন তার বাড়ির সামনে শহীদ মিনার নির্মাণের। এ খবর পেয়ে ফের বিপুলসংখ্যক পুলিশ নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন তৎকালীন এসডিও একে দত্ত চৌধুরী। তার নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী শহীদ মিনারটি ভাঙতে উদ্যত হতেই সদ্য নির্মিত শহীদ বেদির সামনে এসে দাঁড়ান সাহারা খাতুন। বলেন, আমার জায়গায় আমি শহীদ মিনার বানিয়েছি, কার সাহস এটি ভাঙবে? তার এমন রুদ্রমূর্তি দেখে থমকে গেল পুলিশ বাহিনী, চুপ হয়ে গেলেন এসডিও দত্ত চৌধুরী। এর পর সাহারা খাতুন তাদের চলে যেতে বলেন। দত্ত চৌধুরী কথা না বাড়িয়ে পুলিশ বাহিনী নিয়ে সে স্থান ত্যাগ করেন। এটিই মানিকগঞ্জে নির্মিত জেলার প্রথম শহীদ মিনার।

সাহারা খাতুনের অসীম সাহসিকতাপূর্ণ সেই ঘটনার পর পেরিয়ে গেছে ৬৮ বছর। কিন্তু ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ সেই শহীদ মিনারটি এখনো রয়ে গেছে অবহেলিত।

২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৪, ছাত্রজনতার ঢল নেমেছিল এই শহিদ মিনারের বেদীতে। ফুলে ফুলে রঙ্গিন হয়ে গিয়েছিল শহিদ মিনারের বেদী। কিন্তু ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চের পর এ শহিদ মিনারটি মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় পাকহানাদার বাহিনী। ১৯৭২ সাল। দেশ স্বাধীন হবার পর ঠিক একই স্থানে একই ভাবে পুনরায় গড়ে তোলা হয় শহিদ মিনারটি।

২০০৭ সালে মানিকগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রশাসনের উদ্যোগে মানিকগঞ্জের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার নির্মিত হলে প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে মিনারটি। এরপর থেকে প্রথম শহীদ মিনারটিতে শ্রদ্ধা জানানো বন্ধ হয়ে যায়। এক পর্যায়ে এই শহীদ মিনারটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। কয়েক বছর পর সাংস্কৃতিক কমী সংগঠকদের দাবির মুখে মানিকগঞ্জ পৌরসভা কর্তৃপক্ষ শহীদ মিনারটিতে সিরামিক টাইলস লাগিয়ে মেরামত করে। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে কেউ কেউ ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানালেও প্রশাসন, রাজনৈতিক দল, কিংবা আন্যান্য সংগঠন আর এই শহীদ মিনারে আসে না।

বর্তমানে শহীদ মিনারটিকে অবহেলা করে গার্লস স্কুলের শিক্ষার্থীদের অপেক্ষমান অভিভাবকরা বিশ্রামের জায়গা বানিয়েছে। গত দুই বছর আগে বর্তমান জমির মালিক শহীদ মিনার ঘেষে তিনদিকে দেওয়াল তুলে কেবল মাত্র রাস্তার দিকে ফাঁকা রেখেছেন। এখন কেউ দেখলে বুঝতেই পারবে না এটাই মানিকগঞ্জে নির্মাণ করা ভাষা শহীদদের স্বরণে প্রথম শহীদ মিনার। শহীদ মিনারটি‌তে গা‌ছের পাতা প‌রে বি‌ছি‌য়ে থা‌কে। বি‌ভিন্ন ময়লা অবর্জনা দি‌য়ে বি‌ছি‌য়ে থা‌কে এর চার পাশ।

মা‌নিকগ‌ঞ্জে প‌শ্চিম দাশড়া এলাকার বীর মু‌ক্তি‌যোদ্ধা হাজী আব্দুস সামাদ ব‌লেন, ভাষা শহীদদের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে যারা সংগ্রাম করেছেন তাঁদের কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে। তাদের স্বরণ করতে হবে। এই ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানাতে পারলেই তারাও সংগ্রামী হয়ে উঠবে। এই শহীদ মিনারটি মানিকগঞ্জের ঐতিহ্য ও ভাষা আন্দোলনের অনবদ্য ইতিহাসের অংশ। সংরক্ষণের অভাবে এ মিনারটি হারিয়ে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ স্মৃতিচিহ্ন মানিকগঞ্জ থেকে হারিয়ে যাওয়া। এটি মোটেও কাম্য নয়।

মন্তব্য ( ০)





  • company_logo