
নিউজ ডেস্কঃ যুক্তরাজ্য সফররত প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আজকের বৈঠককে সামনে রেখে এক ধরনের উত্তেজনা চারদিকে। বিশেষ করে অতিমাত্রায় রাজনীতিচর্চায় অভ্যস্ত দেশের কোটি কোটি মানুষের মনে ও প্রাণে এ বৈঠককে ঘিরে এক ধরনের উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। আলোচনার বিষয়বস্তু ও ফলাফল জানার জন্য দেশে ও বিদেশে থাকা বাংলাদেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের আগ্রহের যেন কমতি নেই। যেন রুদ্ধশ্বাস এক পরিস্থিতি।
ফলে লন্ডন বৈঠককে সামনে রেখে যেভাবে উত্তেজনার পারদ বাড়ছে তাতে করে বিশ্লেষকদের অনেকে বলছেন, সাম্প্রতিককালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে এ বৈঠকটি এখন ‘রাজনীতির শ্বাসরুদ্ধকর এক ম্যাচ’। রাজনীতি কখনো খেলার সঙ্গে তুলনীয় নয়, তবু চারদিকে এ বৈঠকের আলোচনার উত্তাপ এখন খেলার পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা যেমন গ্যালারি ও টিভি সেটের সামনে বসে মানুষ টানটান উত্তেজনার মধ্যে উপভোগ করে-ঠিক এ বৈঠকের উত্তাপকে অনেকে সেই পর্যায়ে নিতে মরিয়া।
সর্বত্র একই আলোচনা-লন্ডন বৈঠক। শেষ পর্যন্ত কী হবে। আলোচনা ফলপ্রসূ হবে তো, যদি সফল না হয়, তাহলে কী হবে? নানারকম প্রেডিকশন ছুড়ে দিয়ে রাজনীতিপ্রেমী মানুষের সরব আলোচনায় সরগরম রাজনীতি।
আজ দুপুর ২টা থেকে বিকাল ৪টা (স্থানীয় সময় সকাল ৯টা থেকে ১১টা) পর্যন্ত লন্ডনের ডরচেস্টার হোটেলে ঐতিহাসিক এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। ২ ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠকটি ‘ওয়ান টু ওয়ান’ হওয়ার কথা রয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো যুগান্তরকে দুরকম তথ্য দিয়েছে।
কেউ বলছেন, পুরো বৈঠকটি রুদ্ধদ্বার এবং ‘ওয়ান টু ওয়ান’ হবে। আবার কেউ কেউ বলছেন, বৈঠকের একপর্যায়ে কিছু সময়ের জন্য প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একান্তে আলাপ করবেন। তবে শেষ পর্যন্ত বৈঠকটি কীভাবে হবে, সেটি এখন দেখার বিষয়।
আলোচনার এজেন্ডা অফিশিয়ালি কোনো পক্ষ প্রকাশ করেনি। তবে স্বাভাবিকভাবে নির্বাচন, বিচার, সংস্কারসহ রাজনীতিতে সাম্প্রতিক যুক্ত হওয়া অনেক বিষয় আলোচনায় প্রাধান্য পাবে। বিএনপির পক্ষ থেকে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ নিদেনপক্ষে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নিয়ে আসা অন্যতম এজেন্ডা হিসাবে তুলে ধরা হবে। এটি একরকম নিশ্চিত। বিপরীতে সরকার চাইবে এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের সময়সীমা ধরে রেখে সংস্কার ও বিচারের ওপর বেশি গুরুত্ব দিতে।
সূত্র বলছে, তারেক রহমানের দেশে ফেরার প্রাসঙ্গিকতা, জুলাই সনদ, প্রশাসনসহ বিভিন্ন সেক্টরে স্বৈরাচারের দোসরদের অপসারণ, নির্বাচন কমিশন, আদালতের রায়ের পরও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে প্রকৌশলী ইশরাক হোসেনকে শপথ না পড়ানো, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভবিষ্যৎ কাঠামো, রাখাইনে মানবিক করিডর, বন্দরব্যবস্থার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও আলোচনায় উঠে আসবে।
এছাড়া এর বাইরে জাতীয় নিরাপত্তা, পরবর্তী সরকার ও সংসদ এবং ভূরাজনৈতিক নানা বিষয় বাস্তবতার প্রয়োজনে আলোচনায় যুক্ত হতে পারে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, সাধারণ মানুষ আলোচনা শেষে দুই প্রধান আলোচকের মুখে শেষ হাসি দেখতে চান। যে হাসির উচ্ছ্বাস বলে দেবে মতবিরোধ যাই হোক না কেন-আলোচনায় শেষ পর্যন্ত জনগণ জিতেছে। জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী সবকিছু ঠিকঠাক হচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগে বহুল কাঙ্ক্ষিত একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। এপ্রিলের প্রথমার্ধ আর ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধের মধ্যে সময়ের ব্যবধান মাত্র ২ মাস। নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে যদি ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর সার্বিক সমর্থন-সহযোগিতা নিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কারের কাজও এ সময়ের মধ্যেই সম্পন্ন করে ফেলা সম্ভব হবে। তখন সংস্কারের জন্য অতিরিক্ত ২ মাস সময় নিয়ে উত্তপ্ত বৈরী আবহাওয়া আর রমজানজুড়ে নির্বাচনি কর্মকাণ্ডের মধ্যে দেশকে নিয়ে যেতে হবে না। এক্ষেত্রে শুধু দরকার দুপক্ষের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও আস্থার সম্পর্ক, যা সাম্প্রতিক সময়ে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৈ
ঠক প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। অন্যদিকে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তাদের মধ্যকার অনুষ্ঠিত বৈঠকে অনেক বিষয়ে সমাধান হতে পারে বলে আমরা বিশ্বাস করি। বর্তমানে যে একটা অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, সেটারও সমাধান আসতে পারে।
এদিকে এ বৈঠক নিয়ে আশার আলো দেখছেন অন্যান্য দলের রাজনীতিকরাও। গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না যুগান্তরকে বলেন, সরকারের সঙ্গে একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের এমন মতভেদ ও অনৈক্য ভালো দেখায় না। নিশ্চয়ই দুই নেতার মধ্যকার বৈঠকে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা যৌক্তিক সমাধান আসবে। সমঝোতার পথ খুলবে। যার মধ্য দিয়ে জাতির প্রত্যাশা অনুযায়ী গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দেশকে এগিয়ে নেওয়ার পথও খুলবে। রাষ্ট্র সংস্কার ও দেশকে পরিবর্তনের ধাপে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ মিলবে।
ড.ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক সংক্রান্ত খবর পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি প্রসঙ্গে মান্না বলেন, বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাইছে। নিশ্চয়ই এর পেছনে তাদের যুক্তি রয়েছে। আবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের কথা বলেছেন। লন্ডনে বৈঠকের মধ্য দিয়ে আলাপ-আলোচনায় এই টানাপোড়েনেরও একটা সমাধান আসবে নিশ্চয়ই। অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকার দেশকে সুস্থ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এগিয়ে নেবে-এটাই এখন গোটা জাতির প্রত্যাশা।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব ও দলের মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বলেন, দেশবাসী প্রত্যাশা করে লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ও তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠকে দলীয় রাজনীতির বিশুদ্ধতা ও সংস্কারের আলাপ প্রাধান্য পাবে।
বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, লন্ডনে বৈঠকের পর বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির নেতারা বৈঠক করবেন। সেই বৈঠকে পরবর্তী করণীয় নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে লন্ডনের বৈঠক ফলপ্রসূ হলে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে। বৈঠক ফলপ্রসূ না হলে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের জন্য রোডম্যাপ দাবিতে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে।
লন্ডন সূত্র বলছে, বৈঠক ঘিরে নানা প্রস্তুতি নিয়েছেন বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। সকাল থেকে স্থানীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকরা ডরচেস্টার হোটেলের সামনে সংহতি জানিয়ে অবস্থান নেবেন। তারা পুরো বৈঠকের সময়ই সেখানে থাকবেন। দুই নেতার মধ্যে এ বৈঠককে কেন্দ্র করে নেওয়া হবে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা। বৈঠক চলাকালীন হোটেলের নির্দিষ্ট কক্ষের আশপাশেও কারোর অবস্থান না করার বিষয়ে কড়া নির্দেশনা রয়েছে। বৈঠকের মাঝে দুই নেতার জন্য নাশতার ব্যবস্থা থাকছে। বৈঠকের পর দুই পক্ষ থেকেই সাংবাদিকদের ব্রিফ করার কথা রয়েছে।
মন্তব্য (০)