• মুক্তমত

করোনাভাইরাস: উদ্দেশ্য যখন ঝামেলা বিদায় করা এবং নিজে বাঁচা

  • মুক্তমত
  • ০৩ এপ্রিল, ২০২০ ২১:৩৯:১৭

করোনাভাইরাস নিয়ে মানুষের ভয়ভীতি তুঙ্গে। কারও সামান্য সর্দি-কাশি হয়েছে শুনলেও আমরা তাকে গলাধাক্কা দিয়ে পরপারে পার করে দেয়ার চেষ্টা করছি। উদ্দেশ্য, ঝামেলা বিদায় করা এবং নিজে বাঁচা। মনে হচ্ছে, ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’ প্রবাদটি এ করোনাভাইরাস সার্থক করে দিয়ে যাচ্ছে। আমি নিজেও ঘরের মধ্যে বসে আছি। এত ভীতির কারণ হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে অনেক মৃত্যু, আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থার পঙ্গুত্ব এবং সরকারের অব্যবস্থাপনা। বিপদের সময় আমাদের যা করণীয় তা হচ্ছে মনোবল অটুট রাখা। আমি জানি, বিশ্বব্যাপী এত মৃত্যু ও আক্রান্তের খবর শুনে আমরা কেউই নিজেকে ভীতিমুক্ত রাখতে পারছি না। তারপরও বলছি, দেখুন এ ভাইরাস নিয়ে অনেকেই অনেক কথাই বলছে; কিন্তু কেউই বলছে না, আমাদের দেশের বর্তমান আবহাওয়া ভাইরাস বিস্তারের জন্য সহায়ক নয়। শুধু আমাদের দেশেই নয়, এ অঞ্চলের বা পৃথিবীর যেসব দেশে এখন বসন্তকাল বা গরমকালের মতো আবহাওয়া বিরজমান, সেখানে ব্যাপকভাবে এ ভাইরাস বিস্তারের সম্ভাবনা কম। আমি ভাইরাস বিশেষজ্ঞ নই। একজন ভ‚গোলবিদ এবং জিআইএস ও রিমোট সেন্সিং বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিভিন্ন তথ্যের বিশ্লেষণ করা আমার কাজের একটি অংশ। আমার বিশ্লেষণের অংশ হিসেবে আক্রান্তের সংখ্যা (৩১ মার্চ পর্যন্ত) এবং মার্চ মাসের গড় তাপমাত্রা নিয়ে তৈরি একটি চিত্র আপনাদের জন্য তুলে ধরছি। এ চিত্রটি থেকে বলা যায়, যেসব দেশে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি, সেসব দেশে মার্চ মাসের গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি অথবা কম। এসব দেশে ফেব্র“য়ারি মাসের তাপমাত্রা ছিল আরও কম। অন্যদিকে যেসব দেশে আক্রান্তের সংখ্যা কম, সেসব দেশে মার্চ মাসের তাপমাত্রা ছিল ২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি বা বেশি। আরেকটি তথ্য হচ্ছে, বেশি আক্রান্ত দেশগুলোতে (যেমন- যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য) ভাইরাসের আক্রমণ শুরু হয়েছিল জানুয়ারির শেষে। কম আক্রান্ত অনেক দেশেও (যেমন- মালয়েশিয়া, ভারত, ইউএই ও শ্রীলংকা) এটি শুরু হয়েছিল একই সময়ে। ভারতের (প্রথম আক্রান্ত ২৯ জানুয়ারি) মতো একটি জনবহুল দেশে ৩১ মার্চ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ হাজার ৩০০; কিন্তু ইরানে এ সময়ে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪৫ হাজার, যদিও ইরানে প্রথম আক্রমণ দেখা দিয়েছিল ভারতের পর (১৮ ফেব্র“য়ারি)। শুধু তাই নয়, ইরান ও ইরাক পাশাপাশি দেশ; কিন্তু ইরাকে আক্রান্ত মাত্র ৭০০ জন। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন কিছু দেশে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি এবং অনেক চেষ্টা করেও তারা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না? অন্যদিকে কেন কিছু দেশে আক্রান্তের সংখ্যা কম এবং এখন পর্যন্ত প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে রয়েছে? জ্ঞানে-বিজ্ঞানে বা অর্থ-শক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য কি মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, ইউএই, শ্রীলংকা, মিসর ও ইরাকের চেয়ে কম? আমাদের দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা বা অন্যকিছু কি এমন ভালো যে, এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ১০০ অতিক্রম করেনি? একজন ভ‚গোলবিদ হিসেবে মনে হচ্ছে, জ্ঞান-বিজ্ঞান বা অর্থ-শক্তি এ সবই এখানে অনেকটা গৌণ। মুখ্য কারণটি সম্ভবত আবহাওয়া বা ঋতুগত পার্থক্য। ভাইরাস প্রকৃতিতেই আছে এবং থাকবে। উপযুক্ত পরিবেশ পেলেই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। যেসব দেশে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি, সেসব দেশের তাপমাত্রা কম যা কোভিড-১৯ বিস্তারের জন্য সহায়ক। ঠিক উল্টো অবস্থা বিরাজ করছে সেসব দেশে, যাদের আক্রান্তের সংখ্যা কম। আপনারা যে কেউ দুটি ওয়েবসাইট (https://www.weatherbase.com/weather/countryall.php3 Ges https://www.worldometers.info/coronavirus/#countries) অথবা অন্য কোনো উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে তাপমাত্রা এবং কোভিড-১৯-এ আক্রান্তের সংখ্যা দেখলে অনায়াসেই বুঝতে পারবেন, পৃথিবীর খুব কম দেশই আছে যেখানে তাপমাত্রা বেশি এবং কোভিড-১৯-এ আক্রান্তের সংখ্যাও বেশি। অনেক মানুষ আজ আতঙ্কিত। অনেকেই মতাতম পোষণ করছে যে, এ অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ হয়তো কোভিড-১৯-এ মারা যাবে। কিন্তু প্রকৃত তথ্য হচ্ছে, ইউরোপ ও আমেরিকায় মানুষ যে হারে আক্রান্ত হচ্ছে বা মারা যাচ্ছে সেই হারে ভারতীয় উপমহাদেশে বা বেশি তাপমাত্রাসম্পন্ন দেশেগুলোতে আক্রান্ত হচ্ছে না। ফলে ভারত কিংবা মালয়েশিয়া এতদিন আগে আক্রান্ত হলেও তাদের মৃতের সংখ্যা এখনও অনেক কম। অস্বীকার করার উপায় নেই, উপমাদেশসহ এ অঞ্চলের দেশগুলো জনবহুল এবং চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নত নয়; কিন্তু ইউরোপ ও আমেরিকার মৃত্যুহার অনুযায়ী আমাদের মৃতের সংখ্যা গণনা করে মানুষকে অতিমাত্রায় আতঙ্কিত করার প্রয়োজন সম্ভবত নেই। তবে এ অঞ্চলের দেশগুলোর অবশ্যই কঠোর সাবধানতা অবলম্বন জরুরি। আমাদের দেশেও ভাইরাল ফিভার দেখা দেয় ডিসেম্বর বা জানুয়ারি মাসে। ফেব্রুয়ারির শেষে বা মার্চে ভাইরাল ফিভার থাকে না বললেই চলে। কোভিড-১৯ এক ধরনের ভাইরাস। কিন্তু এটি সাধারণ ভাইরাল ফিভারের চেয়ে অনেক বেশি প্রাণঘাতী। সৃষ্টিকর্তার অসীম দয়া যে কোভিড-১৯ ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে আমাদের দেশে আবিভর্‚ত হয়নি। হলে অবস্থা যে কী হতো তা বিশ্বের অন্যান্য দেশের অবস্থা দেখে সহজেই অনুমেয়। এ ভাইরাস অসময়ে এসে নিজে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে এবং আমাদেরও অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। কোভিড-১৯ আমাদের প্রকৃতির (আবহাওয়ার) কাছে এখন অনেকটা অসহায়। আমরা সাহায্য না করলে সে একজন থেকে আরেকজনকে আক্রান্ত করতে পারবে না। আমরা সাহায্য না করলে কোভিড-১৯ লাখ লাখ লোককে মৃত্যুমুখে পতিত করতে পারবে না। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক যে, আমরা নিজেরা অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে নানারূপ আড্ডা, সামাজিক ও অন্যান্য কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একে অপরের কাছে ভাইরাস পৌঁছে দিতে সাহায্য করছি। সরকারের ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই’ অবস্থা। কথার ফুলঝুরি দিয়ে ভাইরাস মারার চেষ্টা করছে। আমি এখনও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, কোভিড-১৯ আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত সীমিত পরিসরেই আছে। ভালো খবর যে, সরকার ছুটি বৃদ্ধি করছে; কিন্তু শুধু লকডাউন করে রাখলেই এর সমাধান হবে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে আস্তে আস্তে একজন থেকে পরিবার, পরিবার থেকে পাড়া, পাড়া থেকে-গ্রাম, গ্রাম থেকে ইউনিয়ন-এভাবেই কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়তে পারে অনেক বড় পরিসরে। একবার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গেলে আমাদের কারও রক্ষা হবে না। আমাদের ভালো চিকিৎসাব্যবস্থা নেই। ভয়েই মানুষ তখন উš§ত্ত হয়ে উঠবে। জনগণকে তখন পুলিশ-সেনাবাহিনী দিয়েও ঠেকানো যাবে না। সরকারের কাছে বিনীত অনুরোধ, যত দ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় টেস্টিং কিট এবং ডাক্তারদের জন্য সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবস্থা করুন। আপনারা যতই বলুন না কেন, সবাই জানে আপনাদের কী রকম প্রস্তুতি ছিল। এখনও সময় আছে। চেষ্টা করলে অতি স্বল্প সময়েই এ ব্যর্থতা ঘুচিয়ে ইতিবাচক কিছু করা হয়তো সম্ভবপর। লকডাউন দিয়ে মানুষদের শুধু বন্দি করবেন না। প্রত্যেক উপজেলা থেকে মাত্র দুটি টেস্ট করা হবে একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এটি এখন গবেষণার জন্য নমুনা সংগ্রহের বিষয় নয়। এটি মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন। একজন মানুষের জীবনেরও মূল্য আছে। সামান্য লক্ষণও যাদের আছে, তাদের সবাইকে অতিদ্রুত কোভিড-১৯ পরীক্ষা করাতে হবে। মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। অনুগ্রহপূর্বৃক দ্রুত টেস্টিং কিট এবং সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবস্থা করে ডাক্তারদের সহায়তা করুন। ইতিমধ্যে শুধু দিনমজুরই নয়, নানা পেশার নিæবিত্তের অনেকেই নানারূপ কষ্টে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। মানুষকে আর এভাবে বেশিদিন রাখা যাবে না। ১১ এপ্রিলের মধ্যেই এর একটা সুরাহা করতে হবে। জনগণের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, কয়েকটি দিন কষ্ট করুন। নিজে বাঁচুন এবং অপরকে বাঁচতে সহায়তা করুন। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা নিজের আশপাশের অসহায় মানুষ এবং আত্মীয়-স্বজনকে সহায়তা করুন। একটু কষ্ট করলে এ সমস্যার আশুই সমাধান সম্ভবপর। অন্যথায় কিছু মানুষের অসহায় মৃত্যু অনিবার্য। অনুগ্রহপূর্বক মনে রাখবেন, কোভিড-১৯ আক্রান্ত মানুষকে কবর দিলে সেই কবর থেকে কোভিড-১৯ ছড়ানোর আশঙ্কা নেই। মাটি ভেদ করে কোভিড-১৯ ছড়ায় না। লেখক: ড. এমএলআর সরকার অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য ( ০)





  • company_logo