পাবনা প্রতিনিধি: পাবনার বেড়া উপজেলার নগরবাড়ী ও নটাখোলায় যমুনা নদীতে এবং সুজানগর উপজেলার ধাওয়াপাড়া ও কালুখালী সহ পদ্মা নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের মহোৎসব চলছে। প্রতিদিন শতাধিক খননযন্ত্র দিয়ে নদীর বুক চিড়ে তোলা হচ্ছে বালু। আর উত্তোলিত বালু নদীপাড়ে রেখে তা অবাধে বেচাকেনা চলছে। বালুখেকোদের পকেটে যাচ্ছে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা। অবাধে বালু তোলায় এরই মধ্যে পদ্মা পাড়ের ১০টি গ্রাম বিলীন হয়েছে এবং আরও অন্ত: ২০টি গ্রাম ভাঙনের মুখে রয়েছে। নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে শত শত বিঘা আবাদি জমি। সরকারিভাবে এসব বালু উত্তোলন নিষেধ থাকলেও একশ্রেনীর অসাধু বালু ব্যবসায়ি তা মানছেন না। সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, পদ্মায় যথেচ্ছ বালু উত্তোলনের ফলে এরই মধ্যে বিলিন হয়ে গেছে সুজানগর উপজেলার সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের ফকিৎপুর, নরসিংহপুর, মানিকহাট ইউনিয়নের বিলমাদিয়া, তিল মাদিয়া, মামুদিয়া, নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের চর বরখাপুর, বিজলীচর, রাণীনগর, বালিয়াডাঙ্গি ও সাদারচর সহ বেশ কয়েকটি গ্রাম। তারপরও সুজানগর উপজেলার নাজিরগঞ্জ, সাতবাড়ীয়া, ভায়না ইউনিয়নের ও পৌরসভার সীমান্তবর্তী এবং জৌকুড়া, ধাওয়াপাড়া, কালুখালী (প্রস্তাবিত সেনানিবাস) এলাকার পদ্মা নদী হতে প্রতিদিন শতাধিক খননযন্ত্র দিয়ে নদীর বুক চিড়ে তোলা হচ্ছে বালু। আর উত্তোলিত বালু নদীপাড়ে রেখে তা অবাধে বেচাকেনা করছে একশ্রেনীর বালু ব্যবসায়ি। আবার নগরবাড়ি ও নটাখোলা ঘাটের পাশে যমুনা থেকেও খননযন্ত্রের মাধ্যমে বালু উত্তোলন করে দীর্ঘ পাইপের মাধ্যমে বালু এনে রাখা হচ্ছে নগরবাড়ি ও নটাখোলা ঘাটের পাশের খোলা জায়গায়। সেখান থেকে বেচাকেনার পর ট্রাক বোঝাই করে পাঠান হচ্ছে বিভিন্ন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছে। এখান থেকে প্রতিদিন লক্ষাধিক টাকার বালু বিক্রি করা হচ্ছে বলে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে। এদিকে সুজানগরের নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের নাজিরগঞ্জ বাজারের আশপাশে এলাকাসহ বরখাপুর, বুলচন্দ্রপুর, সাতবাড়ীয়া ইউনিয়নের সাতবাড়ীয়া বাজার হতে শ্যামনগর ও ভাটপাড়া রাস্তার পাশে এবং রাজবাড়ী জেলার জৌকুড়া, ধাওয়াপাড়া,কালুখালী (প্রস্তাবিত সেনানিবাস) এলাকার বিভিন্ন স্থানে বালু ¯ু‘পাকারে রাখার কারণে যানবাহন চলাচলেও মারাত্মক ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। আর এ সকল সড়ক দিয়ে ভোর রাত হতে ট্রাক, ট্রাক্টর, দিয়ে বিভিন্ন স্থানে বালু পৌছে দেয়া হয়। এতে করে রাস্তার অবস্থাও নাজুক হয়ে পড়েছে। স্থানীয় জনগণ বাধা দিলে বালু উত্তোলণকারীরা তাদের নামে মামলা দায়েরের হুমকি দেন বলে স্থানীয়রা জানান। নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের বরখাপুর গ্রামের বাসিন্দা খালেক হোসেন নামক এক ব্যক্তি কান্না জড়িত কন্ঠে জানান ‘ যথেচ্ছ বালু উত্তোলনের কারণে নদী ভাঙনে আমার প্রায় ৫০ বিঘা আবাদি জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। যে বাড়িতে বসবাস করছি সেটাও বর্তমানে ভাঙনের মুখে রয়েছে।’ বুলচন্দ্রপুর গ্রামের বাসিন্দা মাজেদা খাতুন বলেন,‘ নদী ভাঙ্গনের ফলে তার নিজের বসতভিটাটি এরই মধ্যে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এখন বাধের পাশে অবস্থান নিয়েছি পরিবার নিয়ে।’ বুলচন্দপুর গ্রামের মনজেদ হোসেন নামের একজন জানান, এভাবে বালু উত্তোলন চলতে থাকলে বুলচন্দপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ অন্যান্য বিভিন্ন শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ভেঙে যাওয়ার আশংকা রয়েছে । সাতবাড়ীয়া ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল বাছেত বাচ্চু বলেন, নদী গর্ভে বিলীন হওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের পাশে এসে সহযোগিতা করার বদলে আগে দরকার পদ্মা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধ করা। এতে নদী ভাঙন অনেকাংশে কমে যাবে। নগরবাড়ী এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বাসিন্দা জানান, বালু উত্তোলনের সঙ্গে ২৫-৩০ জন প্রভাবশালী লোক জড়িত। নগরবাড়ী এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা আলম সর্দার, মনির হোসেন মন্টু, চাঁদ আলী মন্ডল, কানু মেম্বার সহ অনেকে জানান, বালুদস্যুদের উত্তোলনকৃত বালু জমিতে স্তুপ করায় এসব এলাকার শতশত বিঘা ফসলি জমির আবাদ এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। বর্ষার সময় বালু তোলার স্থান থেকে বালু গিয়ে গ্রামের ফসলি জমিতে পড়ে। গত কয়েক বছর ফসলি জমি এভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলেও আগামী বর্ষায় ক্ষয়ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হবে বলে তাদের আশংকা। এ ছাড়া বালু উত্তোলনের ফলে যমুনার ¯্রােত দিক পাল্টে গ্রামগুলোতে আঘাত করে। এজন্য নদীপাড়ের গ্রামগুলোর বাসিন্দারা নদীভাঙনের আতঙ্কেও রয়েছে বলে তারা জানান। সুজানগরের নাজিরগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান মশিউর রহমান খান জানান, অবৈধ বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে আমরা দৃঢ়ভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছি, কিন্তু বালু উত্তোলনকারীরা আমাদের কথা শোনেননি। আর বালু ব্যবসাকে কেন্দ্র করে প্রভাবশালীদের নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ওই সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়েছে প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। এ কারণে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছে না। প্রকাশ্যে এভাবে পদ্মা নদী থেকে বালু উত্তোলন হলেও এটি বন্ধে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কোন কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন করছে না বলে তিনি অভিযোগ করেন। সুজানগর উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীনুজ্জামান শাহীন বলেন, এভাবে পদ্মা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে বসতভিটা সহ সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে এই উপজেলার নদীপাড়ের শত শত পরিবার এবং নদী গর্ভে বিলীন হচ্ছে শত শত বিঘা আবাদী জমি। তিনি অবৈধভাবে এ বালু উত্তোলন বন্ধে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন। সুজানগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুজিৎ দেবনাথ জানান, বালু মহাল এবং মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০ অনুযায়ী পাম্প বা ড্রেজিং বা অন্য কোন মাধ্যমে ভ‚-গর্ভস্থ বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না। সর্বোপরি এভাবে বালু উত্তোলন আইনত দন্ডনীয় অপরাধ বলে বিবেচ্য হবে। তিনি জানান, কয়েকবার মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে । বালু উত্তোলনকারিরা অনেক সময় আমাদের আসার খবর শুনে পালিয়ে যায়। তবে অবৈধভাবে পদ্মা নদী থেকে বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলমান রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড বেড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল হামিদ জানান, যমুনা নদীর মোহনগঞ্জ থেকে রাকশা পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিলোমিটার অংশ অত্যন্ত ভাঙনপ্রবণ। অবৈধভাবে বালু উত্তোলন হতে থাকলে যমুনার ভাঙন রোধ করা যাবে না বরং ভাঙন বাড়তে পারে। এছাড়া এভাবে বালু উত্তোলন অব্যাহত থাকলে নদীভাঙন তীব্র আকার ধারণ করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধকে হুমকিগ্রস্থ করবে। সিএনআই
মন্তব্য ( ০)