• বিশেষ প্রতিবেদন

সেন্টমার্টিনে এমন তান্ডব আগে দেখেনি কেউ 

  • বিশেষ প্রতিবেদন
  • ১৪ মে, ২০২৩ ২২:১৪:২৬

ছবিঃ সিএনআই

কক্সবাজার প্রতিনিধিঃ সেন্টমার্টিনের মানুষ ঘূর্ণিঝড়ের এমন তান্ডব আগে দেখেনি কেউ। ১৪ মে রবিবার সকাল ৯ টা থেকে  ঝড়ো হাওয়ার প্রচন্ড বাতাস শুরু হয়। যা দ্বীপের গাছ-পালা, ঘেড়াবেড়া ও ঘরবাড়ি তছনছ করে ফেলে। বিকাল ৪ টা নাগাদ তিব্রতা শেষ করে মোখা নামের এই ঘূর্ণিঝড়টি। যার ফলে  সাত ঘণ্টা সময় শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে কাটাতে হয়েছে সেন্টমার্টিনের বাসিন্দাদের।  এর মধ্যে টেকনাফের সেন্টামার্টিনেই ক্ষতি হয়েছে ১২০০ ঘরবাড়ি। অসংখ্য গাছপালা উপড়ে গেছে। 

প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের সচেতনতামূলক নানা উদ্যোগ এবং স্থানীয় লোকজন সচেতন থাকায় ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’য় বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছেন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরদ। 

তবে ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে কক্সবাজার জেলায় ১০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রাথমিক ভাবে জানিয়েছেন  জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. শাহীন ইমরান। তিনি বলেন, মোখার তাণ্ডব সন্ধ্যা ৬ টার পর পুরোদমে শিথিল হয়ে যায়। এরপর আশ্রয় কেন্দ্রে  থাকা মানুষ ঘরে ফিরতে শুরু করেছে ।

এর আগে রোববার বিকেল আড়াই টার পর থেকে  সেন্টমার্টিন উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় মোখা। বিষয়টি নিশ্চিত করে জেলা আবহাওয়া অফিস। অফিস  প্রধান আবহাওয়াবিদ আব্দুর রহমান বলেন, ‌বিকেল ৩ টার দিকে সেন্টমার্টিন ও টেকনাফ উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড়টি। এতে সেসব এলাকার ঘরবাড়ি, গাছপালা, পানের বরজ ও বিদ্যুতের খুঁটিসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ভেঙে গেছে। রোববার দুপুর ২টা ২০ মিনিট থেকে সেন্টমার্টিনে ১২১ ও টেকনাফে ১১৫ কিলোমিটার বেগে অতিক্রম করছে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’।

এদিকে ঘূর্ণিঝড় মোখায় সেন্টমার্টিনে নিহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তবে বেশ কয়েক  জন আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন বলে  জানিয়েছেন সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের  ৭ নং ওয়ার্ডের সদস্য ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক  সৈয়দ আলম । তিনি জানান 

ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপের অধিকাংশ  শতাংশ ঘরবাড়ি, গাছপালা এবং আবাসিক হোটেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেন্টমার্টিনের মানুষ এ ধরনের প্রাকৃতিক তান্ডব আগে দেখেনি।  ভাগ্য ভালো প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের তৎপরতায় লোকজন সচেতন হয়েছে। আগে থেকেই আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন। না হলে জান মালের ব্যাপক ক্ষতি হতে পারতো। 

অনিয়ন্ত্রিত পর্যটক, ক্রমবর্ধমান দূষণ এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডে এমনিতেই ঝুঁকির মুখে সেন্টমার্টিন দ্বীপের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। তার ওপর ঘূর্ণিঝড় মোখার আঘাতে এবার দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপটি ‘তছনছ’ হতে পারে- এমন শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন সংশ্লিষ্টরা।

সেন্টমার্টিনের  বাসিন্দা সালাউদ্দিন  বলেন, আজ রোববার সকাল ৯ টা থেকে বাতাস শুরু হয়। বেলা সাড়ে ১১ টা নাগাদ তা শক্তিশালী হতে থাকে । বিকেল ৪ টার পর থেকে বাতাস কিছুটা কমতে শুরু করে। বাতাসের তাণ্ডবে দ্বীপে বেশ কিছু ঘরবাড়ি, আবাসিক হোটেল ও গাছপালা ভেঙে গেছে।

স্হানীয় ভিডিপি দলনেত্রী আরজিনা বেগম  বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রচারণা দেখে ভয়ে শনিবার রাত থেকে আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান গ্রহণ করি।

খাবার-দাবার একপ্রকার ছেড়ে দিয়েছিলাম। যেভাবে ভয় পেয়েছিলাম শেষ পর্যন্ত তেমন কিছু হয়নি। আল্লাহ রক্ষা করেছেন।  এখানে আর কোন উপায় ছিল না,যদি এটি সরাসরি দ্বীপের উপর দিয়ে জলোচ্ছ্বাসসহ প্রবাহিত হতো।

সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিসংখ্যান এখনো বলা যাচ্ছে না। সরেজমিন পরিদর্শন করে ক্ষয়ক্ষতির ওয়ার্ডভিত্তিক তালিকা দেওয়ার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের বলা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সেন্টমার্টিন দ্বীপের গলাচিপা এলাকায় পরিবেশ অধিদপ্তরের গবেষণা প্রতিষ্ঠান মেরিন পার্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উড়ে গেছে স্থাপনার ছাউনি। ভেঙে গেছে সোলার প্যানেলগুলো।

একইভাবে হলবনিয়া এলাকায় মৃত কবির আহমেদের ৬ সদস্যের একমাত্র বসতি সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে। এ সময় পরিবারের সব সদস্য আশ্রয় কেন্দ্রে থাকায় কেউ হতাহত হয়নি। কোনারপাড়া এলাকায় ভেঙে গেছে উদয় কটেজ ও সর্ট কটেজ নামের একতলা বিশিষ্ট দুইটি আবাসিক হোটেল।

উদয় কটেজের মালিক কামাল উদ্দিন বলেন, রোববার দুপুর ১ টার দিকে আমার কটেজটি বাতাসে সম্পূর্ণ ভেঙে যায়। এ সময় আমি কটেজের কর্মীদের নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান করায় কেউ হতাহত হয়নি।

বেশকিছু গাছ ও ঘর ভেঙে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ও ঘূর্ণিঝড় নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের প্রধান বিভীষণ কান্তি দাশ। তিনি বলেন, সেন্টমার্টিন দ্বীপে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা এখন বলা যাচ্ছে না। তবে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা দ্রুত দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

বঙ্গোপসাগরের মধ্যে ৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিনের লোকসংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। 

এরমধ্যে গত শুক্রবার দুপুরের মধ্যেই প্রায় হাজার খানেক  মানুষ দ্বীপ ছেড়ে টেকনাফে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য চলে যান। বাকিদের মধ্যে ৫ হাজারের মতো মানুষ দুটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রসহ দ্বীপের ৩৭টি হোটেল রিসোর্ট-কটেজে ঠাঁই নেন বলে জানা যায়। স্থানীয় জনপ্রতিনিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিচ্ছিন্ন দ্বীপ সেন্টমার্টিন ছাড়াও  টেকনাফ সদর, পৌর এলাকা, সাবরাং শাহপরীর দ্বীপ, নয়া পাড়া,  হ্নীলার জাদিমুড়া এলাকায় প্রচুর গাছপালা ভেঙে পড়েছে। উড়ে গেছে ঘরের চালা। বিভিন্ন এলাকায় মানুষকে সড়ক থেকে গাছ সরাতে দেখা গেছে। শহরের বিভিন্ন এলাকার লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিতে কাজ করছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। 

আশ্রয় কেন্দ্রে খাবারের জন্য ছটফটঃ 

ঘূর্ণিঝড় "মোখা " নিয়ে ১০ নং মহাবিপদ সংকেত জারির পর থেকে উপকূলের লোকজন  আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে শুরু করে। এমন একটা আশ্রয় কেন্দ্রের নাম টেকনাফ উপজেলার শাহপরীর দ্বীপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্র। এখানে এই প্রতিবেদক সকাল  রবিবার (১৪ মে) সকাল ১১ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত  অবস্থান  করছিলেন।  তখন ওই আশ্রয় কেন্দ্রে দেখা যায়

শতশত নারী পুরুষ ও শিশু। তারা কেউ শনিবার রাতে আবার অনেকে রবিবার সকালে ওই কেন্দ্রে আশ্রয় নেন। কিন্তু সকাল থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত এখানে শুকনো খাবার বা পানির জন্য ছটফট করতে থাকে আশ্রয় নেওয়া লোকজন। কেউ কেউ দুপুরে এই প্রচন্ড বাতাস উপেক্ষা করে খাবারের জন্য এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে দেখা গেছে। সেখানে আশ্রয় নেওয়া নারী জুলেখা বেগম, দিলদার বেগম, সাদেক মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,"  শুকনো খাবার, পানি ইত্যাদি দেওয়া হবে বলে দ্রুত এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। অতচ কিছু খাবার জন্য সরবরাহ করা হয়নি। বিশেষ করে এতে বাচ্চা ও শিশুদের নিয়ে দারুণ দুর্ভোগ পোহাতে হলো।  

কেন্দ্রে দায়িত্বরত সিপিপি দলনেতা মনির উল্লাহ ও সাবরাং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব সোনা আলী অভিযোগের সুরে বলেন, " দুপুরে টেকনাফ শহর থেকে আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নেওয়া লোকজনের জন্য খাবার পৌঁছানো কথা বলা হলেও। তা কিন্তু দেওয়া হয়নি। " এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আশ্রয় কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা ও একাডেমিক সুপারভাইজার নুরুল আবছার বলেন, " দূর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে ওই সময়ে খাবার পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। " 

মন্তব্য ( ০)





  • company_logo