মশিউর রহমান, সাভারঃ দীর্ঘ ১২বছর ধরে আখ চাষ করে সাবলম্বী হয়েছেন জহুরা বেগম নামে এক নারী। ধামরাই উপজেলার ভাড়ারার বাঙ্গালপাড়া গ্রামের আয়নাল দেওয়ানের মেয়ে জহুরা বেগম।
২০ বছর আগে একই গ্রামের ছেলে শহিদুল এর সাথে বিয়ে হয় তার। সেই সময়ে শহিদুল অটোরিকশা গ্যারেজে কাজ করতো। তখন অভাব আর অনাটনের মধ্য দিয়ে তাদের সংসার চলতো। একটি ভাঙা চার টিনের ছাপরা ঘরে বসবাস করতো তারা। এভাবে কেটে যায় তাদের আটটি বছর। এরইমধ্যে তাদের সংসারে আসে দুই মেয়ে ও একটি ছেলে। শহিদুল সংসারের খরচের ভারে দিশেহারা। সেই মুহূর্তে জহুরা বেগম সিদ্ধান্ত নেন, স্বামীর সংসারের হাল ধরবেন। সেই থেকে প্রথমে অল্প জমি নিয়ে শুরু করেন এই আখ চাষ। এরপর থেকে সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে আসতে থাকে। তাকে আর পিছনের দিকে ফিরে তাকাতে হয়নি। এবছরে সে ১০০ শতাংশ জামিতে আখ করেছেন।
সেই অভাবের দিনগুলোকে স্মরণ করে জহুরা বলেন, জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। একটি ভাঙা চার টিনের ছাপরা ঘরে সংসার শুরু করেছিলাম। এখন আল্লাহর ইচ্ছায় আমার দুটি আধাপাকাসহ তিনটা ঘর আছে। আমার স্বামীর এখন নিজের একটি অটো গ্যারেজ আছে। যেখানে বিশ থেকে ত্রিশ লাখ টাকার মাল রয়েছে। কোন মালামালের অভাব নেই। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি প্রায় ১০লাখ টাকা খরচ করে। একটি ছেলেকে মাদ্রাসায় হেফজো পড়াই। যেখানে প্রতিবছর এক থেকে দেড় লাখ টাকা খরচ হয়। সকলের দোয়ায় সবকিছু এই আখ চাষ করেই করেছি। পাশাপাশি দুটি গরু পালন করতাম, কিন্তু এখন একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছি, ডাক্তার নিষেধ করেছে গরু নিয়ে ঝামেলা করতে। তাই গরু পালন বন্ধ রেখেছি। কিভাবে আখ চাষে উদ্বুদ্ধ হলেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আজ থেকে ১২ বছর আগে যখন আমার সংসারে অনেক অভাব চলছিল তখন কিছু একটা করার চিন্তা করছিলাম। সে সময় গ্রামের কৃষকদের আখ চাষ করতে দেখে আখ চাষের সিদ্ধান্ত নেই। সেই থেকে নিয়মিত আখ চাষ করে যাচ্ছি। আখ চাষের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বেশিরভাগ পরিচর্যা আমি নিজেই করি। পাশাপাশি আমার স্বামী তার অবসর সময়ে আমাকে সহযোগিতা করেন। বলতে বলতে কিভাবে আখ চাষের পরিচর্যা করতে হয় তাও তুলে ধরেন জহুরা খাতুন।
তিনি বলেন আখ চাষীদের জন্য সরকারি সহযোগিতা থাকলে আমরা আরো অনেক ভালো করতাম। যেমন এবছর বৃষ্টি কম হওয়ায় আখের ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু বিক্রি করতে একটু সমস্যা হচ্ছে, তেমন দাম উঠছেনা। এক্ষেত্রে বিক্রির বিষয়ে সরকারি সহযোগিতা আমাদের অনেক প্রয়োজন। অন্যান্য চাষীদের যেভাবে সরকার সহযোগিতা করে আমাদেরকে ওইভাবে সহযোগিতা করলে আমরা আরো ভালো করব ।
গতবছরের তুলনায় এ বছর সার ও তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় চাষের খরচ বেশি হয়েছে। গতবছর পুরো ক্ষেত ১লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করতে পারলেও এবছর ৯০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম উঠেছে। তাই ক্ষেতসহ বিক্রি করছি না। ভেঙ্গে ভেঙ্গে পাইকারদের কাছে বিক্রি করছি আপাতত। এতে একটু সময় লাগবে তবে লাভের পরিমাণ আলহামদুলিল্লাহ ভালো হবে বলে আমি আশাবাদী।
আখ চাষে লসের সম্ভাবনা কেমন ? জানতে চাইলে চাষী জহুরা খাতুন বলেন, ১২ বছরে আমার কখনো লস হয়নি আখ চাষ করে। কোন কোন বছর বড় ধরনের বন্যা হলেও চালান উঠে আসতো। লস না হওয়ায় প্রতিবছরই চাষ করছি। এছাড়াও আখ চাষের পাশাপাশি সাথী ফসল হিসেবে শাক ও বিভিন্ন সবজি চাষ করা যায়। যে কারণে আখের ফলন ঘরে তোলার আগেই এখান থেকে খরচের একটি বড় অংশ উঠে আসে।
একই গ্রামের জহুরা খাতুনের প্রতিবেশী দোকান ব্যবসায়ী জিয়া বলেন, শহীদের বউ জহুরা অনেক কষ্ট করে। অনেক সময় আমরা দেখেছি তাকে মাঠে মাথা ঘুরে পড়ে যেতে। ডাক্তার তাকে পরিশ্রম করতে না করেছে শুনেছি। কিন্তু তারপরও তো দেখি খুব পরিশ্রম করে। শুরুর জীবন অনেক কষ্টের থাকলেও এখন ওরা অনেক ভালো অবস্থানে আছে। এখন লোক দিয়ে কাজ করানোর ক্ষমতা রাখে। কিন্তু বেশিরভাগ সময় দেখি সে নিজেই কাজ করে।
ধামরাই উপজেলার ভাড়ারা ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি অফিসার লাভলী আক্তার বলেন, জহুরা খাতুন দীর্ঘ ১২ বছর ধরে আখ চাষ করছে। আমরা তাকে বিভিন্ন সময়ে আখ চাষে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছি। আমাদের কৃষি অফিস থেকে আখ চাষে কোন প্রকার আর্থিক সহযোগিতার ব্যবস্থা না থাকায় তাকে কোন আর্থিক সহযোগিতা করতে পারেনি। তবে আমি জানি জহুরা খাতুন আখ চাষের মাধ্যমে তার পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছে।
এবিষয়ে ধামরাই উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ আরিফুল হাসান বলেন, এবছরে পুরো ধামরাইতে ২১হেক্টর জমিতে আখ চাষ হয়েছে। এরমধ্যে নারী কৃষক জহুরা বেগমের ইউনিয়নে ৮-৯হেক্টর জায়গায় আখ চাষ হয়েছে। সামনে যাতে এই নারী কৃষক উন্নতজাতের আখ চাষ করতে পারে এবং আধুনিক জাতের আখের বীজ ও সার দিয়ে তাকে সহযোগিতা করা হবে। এছাড়া তাকে সার্বক্ষণিক টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিবেন বলেও আশ্বস্ত করেন।
মন্তব্য ( ০)