• বিশেষ প্রতিবেদন

জামালপুরে ভালো নেই সূবর্ণখালির জেলেরা

  • বিশেষ প্রতিবেদন
  • ০২ আগস্ট, ২০২২ ১৮:২৩:৫৬

ছবিঃ সিএনআই

মোঃ ইমরান মাহমুদ, জামালপুর: তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে। নদীতে জাল ফেলেছেন জেলেরা। জাল নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি নৌকা চালাচ্ছেন সুজন হাওয়ালদার। তিনি হচ্ছেন দলনেতা। নৌকা চালাতে চালাতে কথা হয় তার সাথে। তিনি জানান, বছরের পর বছর মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করলেও এখন তারা ভালো নেই। জলবায়ু পরিবর্তন, নিষিদ্ধ চায়না জাল ও যমুনা সারকারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে সূবর্ণখালির মাছ।

তিনি বলেন, একসময় এ নদীতে সব ধরনের মাছ পাওয়া গেলেও এখন আর পাওয়া যায় না। সারাদিন জাল বেয়ে মাঝে মধ্যেই খালি হাতে ফিরতে হয় তাদের।

জানা গেছে, ১৭৮২ থেকে ১৭৮৭ সালের প্রবল ভূমিকম্প ও বন্যার কারণে দেওয়ানগঞ্জের ঝিনাই খাল থেকে ব্রহ্মপুত্রের নিম্ন প্রবাহ থেকে যমুনা নদীর উৎপত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত সূবর্ণখালিই ছিলো জামালপুরের প্রধান নদী। ঐতিহ্যবাহী এ নদী সরিষাবাড়ী এবং পিংনা হয়ে গোপালপুরের মধ্য দিয়ে প্রবাহমান থাকলেও কালক্রমে এ নদীর নাম ও ঐতিহ্য হারিয়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে নদীর দুই ধারে কয়েকশত জেলে বসবাস করে আসছে। একসময় এ নদীতে জাল ফেললেই মাছ পাওয়া যেতো। এখন আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। তাই আক্ষেপের যেনো শেষ নেই জেলেদের।

কথা হয় তোফাজ্জল হোসেন নামে এক জেলের সাথে। তার বয়স প্রায় ষাটোর্ধ। দীর্ঘদিন ধরেই এ নদীতে মাছ ধরে তার সংসার চলে। তিনি নানা চড়াই উৎরাই দেখেছেন কিন্তু মাছের এমন আকাল দেখেননি। তিনি জানান, আমার সংসার এ জাল টেনেই চলে। এক সময় নদীতে অনেক মাছ পাওয়া গেলেও কারখানার দুষিত বর্জ্যে এখন আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না।

তিনি বলেন, নদীতে জাল ফেলতে কমপক্ষে ১২ জন জেলে লাগে। আজকে ১৬ জন জেলে কাজ করছেন। একবার জাল ফেলে তুলতে সময় লাগে কমপক্ষে তিন ঘন্টা। অথচ মাছ নেই। দিনশেষে একেকজন একশত টাকাও পাবে কি-না তা বলতে পারছেন না তিনি।

পাশে বসে তোফাজ্জল হোসেনের কথা শুনছিলেন আলমগীর হোসেন নামে এক জেলে। তিনি বলেন,' আঙ্গো (আমাদের) অবস্থা এহন (এখন) খুব জটিল-ই, আসো (আগের) বছর হিসেবে এ বছর মাছ নাই-ই ধরা যায়, অনেক জেলে আছিলো আগে, মাছ না থাহার (থাকার) কারণে তারা এহন (এখন) জাল বাওয়া ক্ষ্যামা (বাদ) দিছে। এহন (এখন) অনেকে অনেক কাজ করতাছে, কেউ কৃষি কাজ করতাছে। আমরা তো গরীব মানুষ, সারাদিন খেও দেই, অনেক সময় একশ টেহার (টাকার) মাছও হয় না। এইডা দিয়া চলা খুব সমস্যা।

কথা হয় পোগলদিঘা ইউনিয়নের প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তি সামস উদ্দিন চেয়ারম্যানের সাথে। যিনি একাধারে ১৯৯৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি বলেন, এ নদীর বয়স দুইশত বছরের কম হবে না। একসময় আওনা ইউনিয়নের শেষাংশ থেকে গুলি জাল দিয়ে বড় বড় রুই-কাতলা, বোয়াল মাছ ধরা হতো। অথচ কালের বিবর্তনে এখন সেই মাছ শুধুই স্মৃতি। 

কথা হয়েছিলো নদীতে মাছ কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে, তিনি জানান, সরকার থেকে নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল, ক্ষ্যাতা জাল, চায়না জাল দিয়ে অবাদে রেনু পোনা শিকার করা প্রথম কারণ হিসেবে জানান। এছাড়াও যমুনা সারকারখানার দূষিত গ্যাস নদীতে ফেলার কারণে মাছের প্রজনন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ গ্যাসের কারণে প্রচুর মাছ মরে ভেসে উঠে বলেও জানান তিনি।

উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা সুতপা ভট্টাচার্য বলেন, এখন নদী-নালা, খাল-বিলের পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে মাছের জন্য যেমন পরিবেশের দরকার সেটি বিনষ্ট হওয়ায় দিনদিন মাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন কলকারখানার বর্জ্য এসে নদীতে মিশে মাছের অভয়াশ্রম নষ্ট করছে, ফলে যে পরিমাণ মাছ পাওয়ার কথা সে পরিমাণ মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই সকলকে এগিয়ে আসার আহবানও জানান তিনি।

জামালপুর জেলা মৎস অফিস কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, ন্যাচারাল ব্রিডিং আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে, এছাড়াও জলশায় ভরাট হয়ে গেছে। খেত খামারের ব্যবহৃত কীটনাশকের উচ্ছিষ্ট জলাশয়ে মিশে গিয়ে মাছের প্রজননে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। যে পরিমাণ মাছ ধরার কথা তারচেয়ে বেশি মাছ ধরায় দিন দিন নদীনালা, খালবিল, জলাশয় থেকে মাছ কমে যাচ্ছে।

মন্তব্য ( ০)





  • company_logo