• বিশেষ প্রতিবেদন

জনবল সংকটে খুঁড়িয়ে চলছে পাবনা মানসিক হাসপাতাল

  • বিশেষ প্রতিবেদন
  • ১২ অক্টোবর, ২০২১ ১০:৫০:৫২

ছবিঃ সিএনআই

পাবনা প্রতিনিধি : জনবল সংকটে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে মানসিক রোগের চিকিৎসাসেবায় দেশের একমাত্র বিশেষায়িত পাবনা মানসিক হাসপাতালের কার্যক্রম। চিকিৎসক সংকটে ব্যাহত হচ্ছে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা। মাত্র ৩ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে ৫শ’ শয্যার অন্ত:বিভাগ-বহির্বিভাগ সামলাতে হিমশিম খেতে হয় প্রতিদিন। ৬৪৩টি মঞ্জুরীকৃত পদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে শুন্য ২০১টি পদ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বারবার সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি চালাচালি করলেও কাজ হচ্ছে না। এমন বাস্তবতার মাঝেই আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘অসম বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য’।

১৯৫৭ সালে পাবনা শহরের শীতলাই হাউজে অস্থায়ীভাবে স্থাপন করা হয় পাবনা মানসিক হাসপাতাল। এর দুই বছর পর ১৯৫৯ সালে সদরের হেমায়েতপুরে ১১১ দশমিক ২৫ একর জায়গার উপরে স্থানান্তর করা হয় হাসপাতালটি।

গত বৃহস্পতিবার (০৯ অক্টোবর) দুপুর ১২টার দিকে সরেজমিনে গিয়ে দেয়া যায়, পাবনা মানসিক হাসপাতালের বহির্বিভাগে দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের প্রচন্ড ভীড়। পুরোনো ছোট্ট একটি ভবনে চলছে বহির্বিভাগের কার্যক্রম। নেই বসা কিংবা বিশ্রামের ব্যবস্থা। ভ্যাপসা গরমে ঘামছেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। দরজার সামনে এক কোনে দাঁড়িয়ে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার হাসিমপুর গ্রামের আরিফ বিশ্বাস। তার পায়ের কাছে দেড় বছরের শিশু সন্তান রাহাতকে কোলে নিয়ে বসে তারই মেয়ে লিপি খাতুন। আলাপকালে আরিফ বিশ্বাস জানালেন, সকাল নয়টায় সিরিয়াল দিয়েছেন। দুপুর ১২টা বাজতে চললেও এখনও ডাক্তারের মুখ দেখতে পারেননি। যে ভীড়, কখন ডাক্তার দেখাতে পারবেন তাও জানেন না। পরে অবশ্য একটার দিকে তিনি চিকৎসককে দেখিয়ে বাড়ি ফেরেন।

শুধু, আরিফ বিশ্বাসই নন, তার মতো দেশের দূর-দূরান্ত থেকে মানসিক রোগী নিয়ে পাবনায় আসা স্বজনদেরও একই অবস্থা। একটিমাত্র আউটডোরে চিকিৎসকের কাছে রোগী দেখাতে পোহাতে হয় সীমাহীন দূর্ভোগ। ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ডু থেকে মেয়েকে নিয়ে এসেছেন রবিউল ইসলাম। বলেন, বছর খানেক আগে একবার নিয়ে এসেছিলেন। চিকিৎসায় সুস্থ্য হয়েছিল। আবার মেয়েটা পাগলামি শুরু করেছে। তাই নিয়ে এসেছেন তিনি। কিন্তু এখানে একটু বসা বা বিশ্রামের কোনো ব্যবস্থা নেই। কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার আলম আলী বিশ্বাস তার স্ত্রী কনা খাতুনকে নিয়ে গত ৫ বছর ধরে চিকিৎসা করাচ্ছেন পাবনা মানসিক হাসপাতালে। কিন্তু প্রতিবারই তাকে দূর্ভোগে পড়তে হয়। সিরিয়াল দিয়ে বসে থাকতে হয়। প্রচন্ড ভীড়ে সুস্থ্য মানুষও অসুস্থ্য হবার যোগাড়। চিকিৎসক কম। রোগীকে ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

পাবনা মানসিক হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ বিভিন্ন জনবল সংকট চলে আসছে। এতে সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। মাত্র তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে কোনরকমে চলছে চিকিৎসাসেবা। হাসপাতাল সুত্র জানায়, মোট জনবলের পদসংখ্যা ৬৪৩টির বিপরীতে শুন্য রয়েছে ২০১টি পদ। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণীর চিকিৎসকের ৩১টি পদের মধ্যে শুন্য ২০টি। ৭টি প্রথম শ্রেণীর পদের মধ্যে শুন্য ৩টি। এছাড়া দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা ৩১৬টি পদের মধ্যে ৪১টি পদ শুন্য রয়েছে। ১১৯টি তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী পদের মধ্যে শুন্য ৩৭টি। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ১৭০টি পদের মধ্যে ১০০টি পদই শুন্য রয়েছে।

পাবনা মানসিক হাসপাতালের আবাসিক সাইকিয়াট্রিস্ট মাসুদ রানা বলেন, তারা মাত্র তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ৫শ’ শয্যার হাসপাতালের অন্ত:বিভাগ ও বহির্বিভাগ সামলাচ্ছেন। এটা খুবই কষ্টকর একটা ব্যাপার। তাদের অনেক সময় নাভিশ্বাস উঠে যায়।

হাসপাতালের আবাসিক মেডিকলে অফিসার শাহিন রেজা বলেন, হাসপাতালের অনেকগুলো ওয়ার্ড রয়েছে। কোনো ওয়ার্ডে ৪০ জন রোগী আছে। একজন চিকিৎসকের পক্ষে ৪০ জনের সেবা দেয়া কঠিন। সেখানে প্রতিটি ওয়ার্ডে যদি দু’জন করে চিকিৎসক থাকতো তাহলে প্রতিটি রোগী আরও ভাল চিকিৎসাসেবা পেতেন।

অন্ত:বিভাগে চিকিৎসাধীন রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয় নার্সদেরও। তারপরও মানসিক রোগীদের আপনজন হয়ে সেবা দিয়ে চলেছেন তারা। পর্যাপ্ত লোকের অভাবে তাদেরও দুর্ভোগে পড়তে হয়।

নার্সিং সুপারভাইজার রাশেদা খাতুন ও আব্দুল কাদের বলেন, তারা মানসিক রোগীদের আপনজন হয়ে সেবা দেন। কেউ খেতে না চাইলে তাকে বুঝিয়ে খাওয়াতে হয়। গোসল করিয়ে দিতে হয়। নক কেটে দিতে হয়। ওষুধ খাইয়ে দিতে হয়। তা না হলে তাদের সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। তবে লোকবলের অভাবে তাদের দায়িত্ব পালনে কষ্ট বেড়ে যায়। তারা বলেন, অনেক ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করেন তারা। রোগীদের হাতে মার পর্যন্ত খেতে হয়। ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করলেও তাদের জন্য নেই ঝুঁকিভাতা। সরকারের কাছে ঝুঁকিভাতা চালুর দাবি জানান তারা।

এ বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান জানান, চিকিৎসক পদায়নসহ জনবল সংকটের বিষয়টি নিয়ে বারবার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়া হলেও পরিস্থিতির উন্নতি নেই। উন্নত চিকিৎসাসেবা দিতে জনবল বাড়াতে হবে। মন্ত্রণালয় খুব শিগগরি জনবল নিয়োগ দিয়ে পরিস্থিতির আরো উন্নতি করবে বলে প্রত্যাশা করেন পরিচালক।

মন্তব্য ( ০)





  • company_logo