নাগরপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধিঃ “ নগর থেকে অনেক দূর, প্রাণ পূর্ণিমার নাগরপুর, ধলেশ্বরীর পলিমাখা ধান সরিষায় ভরপুর ”- এই ঐতিহ্যকে বুকে ধারন করে ধলেশ্বরী যমুনা বিধৌত পলল সমতল ভূমি টাংগাইল জেলায় জমিদারদের ঐতিহ্য ও নির্দশন ঘেরা নাগরপুর উপজেলা। জেলা শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার এবং উপজেলা শহর থেকে ১.৫ কিলোমিটার দক্ষিণে কাঠুরী নামক স্থানে সুন্দর, মনোরম এবং আনন্দ ভ্রমনের জন্য জমিদারদের উপেন্দ্র সরোবর বা ১২ ঘাটের বড় দিঘীটি অবস্থিত। স্থানীয় বয়োজৈষ্ট ও ইতিহাস থেকে জানা যায়, আটিয়া পরগনার উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যর মধ্যে একটি হল উপেন্দ্র সরোবর যা স্থানীয়দের নিকট বারো ঘাটের দিঘি নামে পরিচিত।
স্থানীয় বয়োজৈষ্ট কাঠুরী গ্রামের মোঃ চানঁ মিয়া (সাবেক মেম্বার),হাজ্বী মোঃ জুড়ান আলী মোল্লা তাদের বযস প্রায় ১’শত বছরের কাছে। তারা বলেন আজ থেকে ৮৬ বছর আগে রায় বাহাদুর সতীশ চৌধুরী তার বাবা উপেন্দ্র মোহন চৌধুরীর নামানুসারে ১১.২৬ একর বা প্রায় ২৫ পাখি জায়গার উপর এই দিঘিটি খনন করেন। তৎকালিন রায় বাহাদুর সতীশ চৌধুরী উপেন্দ্র সরোবরটির চার পাশ সুপ্রস্থ , ১২ টি পাকাঁ ঘাট এবং ৬টি সুগভীর কুয়া রয়েছে। দিঘিটিতে স্বচ্ছ পানি নিশ্চিত করার জন্য কুপ গুলি খনন করা হয়েছে। এই দিঘি খননের পূর্বে জায়গাটি ছিল একটি বিল যা নেবড়া ডাঙ্গা বিল নামে পরিচিত। ৩ দশক পুর্বেও দিঘির চালায় খেজুর গাছে ভরপুর ছিল। বর্তমানে এর নজির পাওয়া দুস্কর, অন্যান্য বিভিন্ন সবুজ গাছপালা চালার চার পাশে দৃশ্যমান। দিনের অধিকাংশ সময়ে হরেক রকমের পাখির মিষ্টি ডাক আর কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত থাকে এই সরোবরটি। দিঘির স্বচ্ছ পানি রুক্ষ-কঠিন মনকেও করেছে বিমোহিত। এখনো মন হারায় প্রকৃতির সুবাতাস ও দিঘির জলে।
কথিত আছে, কোন এক জোৎস্না রাতে জমিদার রায় বাহাদুর চৌধুরী তার সঙ্গীদের নিয়ে নিজের বৈঠকখানায় জোৎ¯œা দেখতেছিলেন। রায় বাহাদুর হঠাৎ লক্ষ করলেন রাতের বেলায় তার এলাকার কিছু লোক কলস কাখেঁ দুরের ঐ বিলের দিকে যায় কেন? রায় বাহাদুর জানতে চাইলেন এরা রাতের বেলায় কোথায় যায়? তিনি খবর নিয়ে জানতে পারলেন তার এলাকার প্রজারা সুপেয় পানির কষ্টে আছে তাই তারা রাতে বিল থেকে পানি এনে সংগ্রহ করে রাখে। এ ঘটনায় রায় বাহাদুর অত্যন্ত ব্যথিত ও মর্মাহত হয়ে নেবড়া ডাঙ্গা বিলের উপর বড় করে একটি দিঘি বা সরোবর খননের উদ্যোগ গ্রহন করেন। সেই সময়ে বিহার থেকে খনন বিশেষজ্ঞ এনে ৬০০ শ্রমিক দিয়ে ৩ বছর সময় কাজ করে অর্থাৎ ১৩৩৮ সন থেকে ১৩৪১ সন পর্যন্ত এই দিঘি খনন করে। জমিদার রায় বাহাদুর তার অধিকাংশ কাজ কর্ম দেখবাল করতেন বাবু ভবানী সেন নামে এক ব্যক্তি।
ভবানী সেনকে সবাই সেন কোম্পানী নামে চিনতেন। দিঘির বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে আশেপাশের গ্রাম কাঠুরী, বারাপুষা, দুয়াজানী, চারাবাগ, আন্দিবাড়ি, মেঘনা গ্রামের শ্রমিক দিয়ে কাজ করাতেন। আর এই শ্রমিকদের সরদার ছিলেন বারাপুষা গ্রামের কামাল সরদার। এটিও শুনা যায় দিঘির সৌর্ন্দয বৃদ্ধির জন্য কলিকাতা থেকে ঘাস এনে লাগানো হয়েছিল। কাঠুরী গ্রামের নায়েব আলী একটি ধুয়া গান তৈরি করেন। এই গানটিতে দরদ দিয়ে সুর দিতেন কাঠুরী গ্রামের হাতেম আলী, রমজান আলী ও হাসু বয়াতি। গানের কথাগুলিই জমিদার পরিবারের পরিচয় দিয়ে দেয়। সৌখিন মাছ শিকারিদের জন্য সে সময় মাছ চাষও শুরু করেন এই দিঘিতে। উপেন্দ্র সরোবরের চার দিকে ঘুরলে প্রকৃতির অপরুপ শোভায় মন ভরে যায়। সরোবরের পশ্চিম পাশে প্রধান বা মেইন গেটের পাশে মাথার উপর কালের স্বাক্ষী হয়ে দাড়িঁয়ে আছে বট ও পাকড় গাছ। যার বয়স ৮৬ বৎসর। এই গাছের বির্স্তীন ছায়া ভ্রমন পিপাসু ও স্থানীয়দের হৃৃদয় জুড়িয়ে দেয়। দিঘির উত্তর পারে দাড়িঁয়ে আছে সারি সারি গাছ। এই গাছের নিচে দাড়ালে এক অন্য রকম অনুভূতি সৃষ্টি হয়। দিঘির এই মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে প্রতিটি অনুষ্ঠান বা পার্বনে অর্থাৎ ঈদ, পুঁজা , বৈশাখি, ১৩ ভাদ্র সহ প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থান থেকে আগত দর্শনার্থীরা ভিড় করেন।
এই উপেন্দ্র সরোবরে এক দিন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পর্যটকরা বেড়াতে আসতেন। প্রতিদিনই বিকেলে সরোবরে জমে উঠে তরুন-তরুনির আড্ডা। জেলার বিভিন্ন এলাকায় অনেক সম্পদ আছে কিন্তু মাইন্ড ফ্রেশ করার মত কিংবা একটু স্বস্থি নিশ্বাস ছাড়ার মত মনোরম কোন জায়গা নেই । শহরের চার দেওয়ালের গন্ডি আর যান্ত্রিক একঘেয়ামি ব্যস্ততামুখর জীবন থেকে প্রশান্তির জন্য ঘুরে আসার মতো একটি স্থান হলো এই উপেন্দ্র সরোবর। সেই ক্ষেত্রে সর্বস্তরের জন সাধারনের একটু স্বস্থি নিশ্বাস ছাড়া ও গ্রহন করার মত ভাল, সুন্দর, মনোরম এবং আনন্দ ভ্রমনের জন্য জমিদারদের উপেন্দ্র সরোবর বা ১২ ঘাটের বড় দিঘীটিকে পর্যটন কেন্দ্র তৈরি করার খুবই উপযুক্ত একটি স্থান। দিঘির অধিকাংশ ঘাটই ব্যবহার উপযোগি নয়। বর্তমানে পুকুরের ভিতরে কচুরি পানায় ভরে গেছে এবং পানি দুষিত হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে এই সরোবরটি পর্যটনের জন্য সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। তাই সরকারের নিকট এলাকাবাসীর প্রাণের দাবি সরোবরের সৌর্ন্দয্য ও জৌলুস ফিড়িয়ে আনতে রক্ষনা বেক্ষন ও সুরক্ষার ব্যবস্থা করে সরোবরটিকে পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করে জমিদারের স্মৃতিচিহ্ন ধরে রাখতে।যথাযথ পরিচর্যার অভাবে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে
মন্তব্য ( ০)