• বিশেষ প্রতিবেদন

আয়ের অর্ধেক ব্যয় হয়ে যায় ঘোড়ার পেছনেই

  • বিশেষ প্রতিবেদন
  • ০৪ মে, ২০২১ ১০:৩০:৩১

ছবিঃ সিএনআই

চাটমোহর (পাবনা) প্রতিনিধি : প্রভু ভক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী ঘোড়া। প্রায় ৪ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে দ্রুত গতির এই চতুষ্পদ প্রাণীটিকে পোষ মানিয়ে মানুষ গৃহে পালন শুরু করেন। দ্রুত গতি সম্পন্ন বলে এ প্রাণী তার প্রভুকে দ্রুত গন্তব্যে পৌছে দিতে সক্ষম হয়। শুধু তাই নয় এক সময় যুদ্ধ ক্ষেত্রেও ঘোড়ার ব্যপক ব্যবহার হয়েছে।

মানুষের মনোরঞ্জনে আমাদের দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘোড়া দৌড় এর আয়োজন করা হয়। তা ছাড়া ভর বহনেও ঘোড়ার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। ঘোড়ার পিঠে অথবা ঘোড়ার গাড়িতে করে ভর বহন করে অনেকে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।

১৩ বছর যাবত ঘোড়ার গাড়িতে মালামাল বহন করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছেন পাবনার চাটমোহরের নিমাইচড়া ইউনিয়নের বরদানগর গ্রামের মোজাম মোল্লার ছেলে জয়নাল আবেদীন (৩৬)। বসত বাড়ি ছাড়া আর কোন জমা জমি নেই তার। কিশোর বয়স থেকে দিন মজুরীর কাজ করতেন। এলাকায় কাজ না থাকলে অন্য এলাকায় যেতেন কাজের সন্ধানে। কিন্তু পরের বাড়িতে কাজ করতে ভাল লাগতো না তার। ১৩ বছর পূর্বে মানিক গঞ্জে দিন মজুরীর কাজ করার সময় ঘোড়ার গাড়িতে ভর বহন করে জীবিকা নির্বাহ করতে দেখেন অন্যদের।

এখান থেকেই ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহের কথা ভাবতে থাকেন তিনি। কদিন পর বাড়ি ফিরে একটি ঘোড়ার গাড়ি তৈরী করেন এবং একটি ঘোড়া কিনেন। সেই থেকে আজ অবধি ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে জীবন জীবিকা নির্বাহ করছেন তিনি।

জয়নাল আবেদীন জানান, “দুই ছেলে এক মেয়ে ও স্ত্রীসহ পাঁচ জনের সংসার চালাতে হয় আমাকে। বড় ছেলে মানিক চরনবীন ভোকেশনাল ইন্সটিটিউটে নবম শ্রেণীতে, দ্বিতীয় ছেলে রতন স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে এবং ছোট মেয়ে জান্নাতুল দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ছে। সংসারের চাল ডালসহ নিত্য পণ্যের যোগান দেওয়ার পাশাপাশি সন্তানদের পড়া লেখার খরচও জোগাতে হয় আমাকে। বাবা ফসলের মাঠ রক্ষকের কাজ করেন। আমার বাবা-মা ও দাদীর পৃথক সংসার। কখনো কখনো বাবাকেও সাহায্য করতে হয়। ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে সব করছি। চৈত্র বৈশাখ মাসে কৃষকের রসুন, গম, খেশারী, মশুর, সরিষাসহ অন্যান্য ফসল বহন করি।

জৈষ্ঠ- আষাড় মাসে বোরো ধান বহন করি। কার্তিক অগ্রহায়ন মাসে বিল থেকে আমন ধান বহনের কাজ করি। এর বাইরে শুষ্ক মৌসুমে বিভিন্ন হাট বাজারে মানুষের মালামাল আনা নেওয়া করি। এলাকার রাস্তা কাঁচা হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে তা অনেক সময় কর্দমাক্ত থাকে। কখনো কখনো ডুবে যায়। এসময় প্রায় চার মাস ঘোড়ার গাড়ি চালানো সম্ভব হয় না। এসময়টা ঢাকায় ইট বহনের কাজ করি। ভর বহন করে গড়ে প্রতিদিন ৪শ থেকে ৫শ টাকা হাতে পাই। এর মধ্যে ঘোড়ার খাদ্য ছোলা, যব, চালের গুড়া বাবদ প্রতিদিন প্রায় ২শ টাকা খরচ হয়ে যায়। সব দিন কাজ পাই না। কিন্তু ঘোড়াকে প্রতিদিনই খেতে দিতে হয়।” চাটমোহরের প্রায় ৭০ থেকে ৮০ জন মানুষ ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে বলেও জানান তিনি।

একই গ্রামের মৃত হায়াত উল্লা খাঁ’র ছেলে ঘোড়ার গাড়ি চালক মতিউর (২৫) জানান, অভাবের সংসারে কখনো পড়া লেখার সুযোগ হয়ে ওঠে নি। কিশোর বয়সে অন্যের বাড়িতে ভাতের বিনিময়ে ২ বছর কাজ করি। এর পর কয়েক বছর স্বল্প বেতনে কৃষকদের বাড়িতে কৃষি কাজ করি। প্রতিবেশিকে ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে দেখে তিন বছর পূর্বে ৪৫ হাজার টাকায় একটি টাটু ঘোড়া কিনি ও ১০ হাজার টাকা খরচ করে একটি ঘোড়ার গাড়ি বানাই। দুই ছেলে ও স্ত্রীসহ চারজনের পরিবারের ভরণ পোষণের খরচ জোগাতে হয় আমাকে। ভর বহন করে প্রতি দিন গড়ে ৪ থেকে ৫শ টাকা পেলেও এর মধ্যে ঘোড়ার খাদ্য বাবদ প্রায় ২শ টাকা খরচ হয়ে যায়।

মাঠে ১ বিঘা জমি রয়েছে আমার। অবসর সময়ে সে জমিতে কাজ করি। প্রতিকূলতা সম্পর্কে তিনি জানান, সব সময় কাজ থাকেনা। বর্ষায় কয়েক মাস উপার্জন না থাকলেও ঘোড়াকে তো প্রত্যহ খাবার দিতে হয়। সারা বছরে আয়ের অর্ধেক ব্যয় হয়ে যায় ঘোড়ার পেছনেই। সব মিলিয়ে কোন রকমে পরিবার পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন চলে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।

মন্তব্য ( ০)





  • company_logo