ছবিঃ সিএনআই
এ কে সরকার শাওনঃ বর্ষার শেষ দিনে মনে বাজে বেদনার সুর। নীল বেদনায় নূইয়ে পড়ে আমার হৃদয়। আমার মনের মতই বর্ষাকালে আকাশে মেঘের রং বদলায় প্রতিনিয়ত। ঠিক তাই বৈচিত্রময় এই ঋতুটাকে আমি বড় বেশী ভালবাসি। বর্ষা এবং বৃষ্টি অন্য সবার মত আমার মনেও প্রচন্ড আবেগের সৃষ্টি করে। বড় বড় কবি সাহিত্যিকগণও এই বর্ষাকাল নিয়ে অনেক কবিতা ও গান লিখেছেন। বাংলা সাহিত্যে একমাত্র বর্ষারই বহুবিধ, বিচিত্র ও সার্থক ব্যবহার হয়েছে। এবং তা হয়েছে বাংলা কবিতায় ও গানে। বর্ষাকাল নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক গান লিখেছেন। তাঁর গীত বিতানেই শুধু বর্ষা নিয়ে গানের সংখ্যা ১২০টি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বর্ষার যে গানগুলি আমার মনে দাগ কেটেছে তা হলো
১. “বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান/ আমি দিতে এসেছি শ্রাবনের গান। ”
২. “পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে/পাগল আমার মন জেগে ওঠে”
৩. “এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়। “
৪. “আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে” ইত্যাদি
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন,
“আজি বাদল ঝরে মোর একেলা ঘরে। ”
বর্ষা নিয়ে মহাকবি কালিদাস রচনা করেছেন মহাকাব্য ‘মেঘদূত’। মেঘকে সেখানে বন্ধু বলা হয়েছিল।
কবি শামসুর রাহমান বলেছেন: ‘বর্ষাকে আমি ভালবাসি আমার প্রিয়জনের মত করে। ’
পল্লীকবি জসীমউদদীন ‘পল্লীবর্ষা’ কবিতায় লিখেছেন,
“বউদের আজ কোনো কাজ নাই।
বেড়ায় বাঁধিয়া রসি
সমুদ্র কলি শিকা বুনাইয়া
নীরবে দেখিছে বসি। ”
খ্যাতিমান কথাশিল্পী, চলচ্চিত্র ও নাটক নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের লিখা, “যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো, চলে এসো এক বরষায়” গানটি অনন্য ও অসাধারন। প্রায় প্রতিটি বৃষ্টির রাতেই এ গানটি আমি গুন গুন করে গাই। এ এক অন্যরকম ভাললাগা। ভালবাসার মানুষকে অন্যভাবে আহবান করা।
১৯৭২ সালে এস এম শফি পরিচালিত “ছন্দ হারিয়ে গেল” ছায়াছবির সেই কালজয়ী গানটি, “রিমঝিম বরষাতে কত কথা মনে পড়ে” আমার মত কোটি মানুষের মনে আজো চিরভাস্বর হয়ে আছে। গানের কথা:গাজী মাজহারুল আনোয়ারের সুরঃ আনোয়ার পারভেজ শিল্পী: সাবিনা ইয়াসমিন। এ গানটি আমাকে নষ্টালজিয়ায় ভোগায়।
উপমহাদেশ তথা বিশ্ব সঙ্গীতের বরনীয় শিল্পী মেহদী হাসানের গাওয়া গান আমার মনে ব্যাপক দাগ কেটেছে। সেটা হচ্ছে রাজা সাহেব ছায়াছবির, “ঢাকো যতনা নয়ন দুহাতে বাদল মেঘ ঘুমাতে দেবে না এমন মোহন শ্রাবন রাতে ভেজা হাওয়া যে ঘুমাতে দেবে না। ” সত্যি এ গান আমাকে ঘুমাতে দেয় না। গানটি রচনা করেছেন ডঃ মনিরুজ্জামান এবং সুর করেছেন আলী হোসেন। যার হৃদয় ভালবাসায় ভরপুর এবং যেই মন কখনও ভালবেসেছে সেই মনকে এই গান আবেগতাড়িত করবেই।
নিলুফার ইয়াসমিনের গাওয়া আরেকটি কালজয়ী গান, যে গান বর্ষা এলেই নিজের অজান্তেই কণ্ঠে চলে আসে-
‘এক বরষায় বৃষ্টিতে ভিজে
দুটি মন কাছে আসলো,
এক সমুদ্র কল্পনা বেয়ে
দুটি মন ভালবাসলো”
বর্ষাকাল নিয়ে আর একটি অতি চমৎকার গান। শুনলে আপনার আমার সবার মন ছুঁয়ে যাবে। মন ভিজে যাবে। সেই গানটি হচ্ছে কাওসার আহমেদ চৌধুরীর লিখা ও লাকী আখন্দের সুর করা ওস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরীর কন্ঠে
“আজ এই বৃষ্টির কান্না
দেখে মনে পড়লো তোমায়,
অশ্রু ভরা দুটি চোখ,
তুমি ব্যথার কাজল মেখে
লুকিয়েছিলে ঐ মুখ। । ”
বর্ষাকাল নিয়ে রচিত অনেক অনেক সুন্দর সুন্দর গান আছে। ভাল লাগার গান আছে। পৃথিবীর সবার মঙ্গল কামনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বর্ষার গান হলো, “বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি”।
বর্ষার শুরু ও শেষ নিয়ে আমার লিখা কবিতা আছে বর্ষা , আষাঢ়ের শেষ দিন ও শ্রাবণের ছায়ামূর্তি। শ্রাবণের ছায়ামূর্তি কবিতায় লিখেছিলাম
শ্রাবণের রাত্রি শুধু প্রতীক্ষার;
বিমুর্ত প্রতীক বিরহ বেদনার!
জলের তলে আগুন জ্বলে,
সাথী আমার শুধু হাহাকার!
আষাঢ়ের শেষ দিন কবিতায় লিখেছিলাম
সেদিন বাহিরে আষাঢ়ে ছিল;
ভিতরে ছিল মায়ের ভালবাসা!
আজ আষাঢ় ভিতরে বাহিরে
মুখে হাঁসি বটে চারিপাশে বরষা!
সেই প্রিয় বর্ষাকাল আজ বিদায় নিচ্ছে। যদিও শরৎ আসছে। গাঢ় নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলায় মন আবারও হারাবে। কাশবনের ছায়ায় আবার নীজেকে অন্যভাবে অন্যকোথাও আবিস্কার করবো। এই বিদায় বেলায় কবি কাজী নজরুল ইসলামে গানটি আবারও স্মরণ করছি।
বর্ষা বিদায়ে তিনি লিখেছেন,
“ওগো বাদলের পরী!
যাবে কোন্ দূরে ঘাটে
বাঁধা তব কেতকী পাতার তরী!”
শেষ বিদায় জানাতে হবে কবিগুরুর কালজয়ী সেই বিদায়ী গান দিয়ে।
“বাদল-ধারা হল সারা, বাজে বিদায়-সুর।
গানের পালা শেষ ক’রে দে রে, যাবি অনেক দূর॥
এ কে সরকার শাওন
শাওনাজ, উত্তরখান, ঢাকা
মন্তব্য ( ০)