সাতকানিয়া প্রতিনিধিঃ ইমাম-মুয়াজ্জিনরা সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি অথচ, তারা অর্থকষ্টে জীবন-যাপন করেন। হয়তো আমরা জানি অথবা জানি না বা জানার চেষ্টাও করি না। যে ইমামের পিছনে আমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করি, যে মুয়াজ্জিন আমাদের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের দিকে আহ্বান করেন তাদের জীবন কীভাবে অতিবাহিত হচ্ছে? বর্তমান সময়ে আমাদের ছেলেমেয়েদের লেখা পড়ায় যে পরিমাণ টাকা খরচ হয়। তার সমপরিমাণ বেতন পায় আমাদের সমাজের সম্মানিত ইমাম-মুয়াজ্জিনরা। গ্রামের অনেক ইমাম-মুয়াজ্জিনের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, চার-পাঁচ হাজার টাকা এখনো বেতন পায়।
এর মধ্যেও কয়েক মাস বকেয়া থাকে। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত বৃদ্ধির প্রতি লক্ষ রেখে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের উপযুক্ত বেতন-ভাতা দেওয়ার সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে। বেশির ভাগ মসজিদ কমিটি মসজিদের অবকাঠামোগত খরচকে যতটা গুরুত্ব দেয়, ইমাম-মুয়াজ্জিনদের বেতন-ভাতার ব্যাপারে তার ততটা গুরুত্ব দেয় না। মসজিদে লাখ লাখ টাকায় উন্নত কার্পেট, লাইটিং, টাইলস, এয়ারকন্ডিশনের মতো আয়েশি খাতগুলোতে অর্থ ব্যয়ের প্রতিযোগিতা থাকলেও ইমাম-মুয়াজ্জিনের একান্ত প্রয়োজন মেটানোর মতো সম্মানী দিতে কৃপণতার প্রতিযোগিতা লক্ষ করা যায়।
ভাবখানা এমন যে মসজিদের আয় নিজেদের আয়েশের জন্য; ইমাম-মুয়াজ্জিনের জন্য নয়। মসজিদের অন্য সব খরচই প্রয়োজনের, শুধু ইমাম-মুয়াজ্জিনের সম্মানীটাই অপ্রয়োজনের খাত। আলোকসজ্জা ও এয়ার ফ্রেশে বছরে হাজার হাজার টাকা খরচ করা হলেও মন বাধা দেয় না, কিন্তু বছর শেষে ইমাম-মুয়াজ্জিনের সম্মানী বাড়ানোর প্রসঙ্গ এলেই যেন কমিটির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি মুসলমানের জীবনের সঙ্গেই কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে আছেন ইমাম-খতিব ও মোয়াজ্জিনরা। খতিব সাহেব যেমন প্রতি জুমায় সমাজের সমস্যাগুলো তুলে ধরে এর ধর্মীয় সমাধান বর্ণনা করেন, সমাজের মানুষের পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে যেমন উদ্বুদ্ধ করেন।
মুসলমানদের সন্তানদের নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও থাকে ইমামের মমতার হাত। সেই তিনিই থাকেন চরমভাবে উপেক্ষিত। তথ্যানুসারে দেশে মসজিদ রয়েছে ৩ লাখ ৩১ হাজার ১২৫টি। তন্মধ্যে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম, চট্টগ্রামের জমিয়াতুল ফালাহ ও আন্দরকিল্লাহ শাহি মসজিদ, রাজশাহীর হেতেম খাঁসহ কয়েকটি মসজিদের ইমাম-খতিবসহ সংশ্লিষ্টরা সরকারি স্কেলে বেতন-ভাতা পান। এর বাইরে সরকারের নির্মাণাধীন ৫৬০টি মডেল মসজিদের বেতন স্থানীয় প্রশাসন নির্ধারণ করে। এ ছাড়া অন্যসব মসজিদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা মসজিদ পরিচালনা কমিটি এলাবাসীর সহায়তায় ব্যবস্থা করে।
প্রতিটি মসজিদে গড়ে তিনজন করে লোক কর্মরত থাকলে এ সেক্টরে কর্মরত প্রায় ১০ লাখ মানুষ। আলোচ্য বিষয়ে দারুল উলুম দেওবন্দের একটি ফতোয়া উল্লেখ করা যেতে পারে। দেওবন্দ থেকে প্রকাশিত ফতোয়ায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘যে মসজিদে ইমামের বেতন কম দিয়ে মসজিদ নির্মাণের জন্য চাঁদা কালেকশন করে বা কালেকশনের চাঁদা ইমামকে না দিয়ে মসজিদ নির্মাণের জন্য রেখে দেয়, সেই মসজিদে চাঁদা দেওয়া হারাম।’ আর মিসরের আজহার থেকে প্রকাশিত ফতোয়ায় বলা হয়েছে, ‘বর্তমান অবস্থায় ইমামদের ১৫-২০ হাজার টাকার কম বেতন দেওয়া মানে, ইমামদের প্রতি জুলুম করা, তাই কেয়ামতের দিন আল্লাহ মসজিদের কমিটিকে জালেমদের কাতারে রাখতে পারেন।
ফতোয়ায় আরও বলা হয়েছে, যে মসজিদের এই পরিমাণ সামর্থ্য নেই-সেই মসজিদকে অন্য একটি মসজিদের সঙ্গে মিশে যাওয়া। সাতকানিয়া উপজেলার ওলামা পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক এবং মাইজ পাড়া ফকিরিয়া জামে মসজিদ ইমাম মাওলানা নোমান উদ্দিন বলেন, পরিবার-পরিজন নিয়ে অভাব অনটনে দিনাতিপাত করছেন বেশিরভাগ মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন।
এটাকে ভাগ্যের স্বাভাবিক ফয়সালা বলেই নীরবে সয়ে যাচ্ছেন সব ধরনের যন্ত্রণা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক খতিব বলেন, বাংলাদেশের মসজিদ পরিচালনা কমিটির মধ্যে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের অনুপ্রবেশ ঘটে যাওয়ায় ইমামরা জাতীয় কোনো ইস্যুতে কথা বলতে ভয় পান বা চুপ থাকেন এবং এ দুর্বলতার কারণেই অনেকে বিভ্রান্ত হন। মসজিদ কমিটিতে থাকা রাজনৈতিক দলের সদস্যরা তাদের মতের লোককে সমর্থন করে থাকেন।
সব সময় সব এলাকার মসজিদে তাদের মন জুগিয়ে চলতে হয়। মতের বিরুদ্ধে গেলে চাকরি নিয়ে টানাটানি শুরু হয়। ইমামদের চাকরি হারানোর ভয়ে থাকতে হয় সব সময়। তাই সর্বোচ্চ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মসজিদ কমিটিগুলোকে পলিটিক্সের বাইরে রাখা জরুরি বলে মনে করেন আলেমরা। বিভিন্ন মসজিদের ইমামদের সাথে কথা বলে জানা যায়, খাওয়া থাকা ফ্রি, রাতে থাকতে হয় মসজিদে সিঁড়ি নিচে অথবা মসজিদে বারান্দ, নেই মানসিক স্বস্তি প্রচণ্ড চাপের মুখে থাকতে হয়।
মন্তব্য ( ০)